রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের দর-কষাকষির একটি ফোনালাপ ফাঁ’সের পর ইসলামী ব্যাংকে জমা দেওয়া ২ লাখ টাকার একটি রশিদের খোঁজ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া।
উপ-উপাচার্যের দাবি, চাকরিপ্রত্যাশী আইন বিভাগের নুরুল হুদা অ’সাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছেন- এমন তথ্য পেয়েই তার স্ত্রীকে সতর্ক করার জন্য উপ-উপাচার্য ফোন দিয়েছিলেন।
তবে চাকরিপ্রত্যাশী নুরুল হুদা বলছেন, নীলফামারির সৈয়দপুরে ইসলামী ব্যাংক শাখায় ২ লাখ টাকা জমা দেওয়ার সেই রশিদটি পাঠিয়েছিলেন তিনি নিজেই। উপ-উপাচার্যকে সেই রশিদটি দেওয়ার জন্য গত বছরের ১১ নভেম্বর তার ভাগনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমানকে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
ফেসবুক মেসেঞ্জারে গাজী তৌহিদুর রহমানকে পাঠানো সেই রশিদটির একটি স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, গাজী তৌহিদুর রহমান প্রথমে নুরুল হুদাকে হাই (hi) বলেছেন। এরপর নুরুল হুদা হ্যালো (hlw) বলেন। তারপরই সেই রশিদটি ওই শিক্ষকের মেসেঞ্জারে পাঠান হুদা।
অথচ গত ১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হলে বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারি যে, হুদা অ’সাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে।
এ রকম একটি লেনদেনের ডকুমেন্ট ১৩/১১/২০১৮ তারিখের চাকরির বোর্ডের আগে আমার নজরে আসে (নীলফামারির সৈয়দপুর শাখার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: এর ৪/১১/২০১৮ তারিখের ৮০০০৭৩৯ ক্রমিকের একটি ব্যাংক জমা স্লিপ)। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে এহেন অ’সাধুকর্ম রোধকল্পে খোঁজ নেওয়ার জন্য হুদার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। কারণ, হুদার স্ত্রীর বাড়ি সৈয়দপুরে, হুদার স্ত্রী সেসময় ব্যাংক লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করেছিল। কিন্তু বিস্তারিত বলতে রাজি হয়নি।
তবে ইসলামী ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখায় কার কাছে সেই টাকাটি পাঠানো হয়েছিল বা কে পাঠিয়েছিল, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সেই রশিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার ভাগনে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমান বলেন, নুরুল হুদা চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিয়েছিলেন। যে রশিদটা সামনে আসছে, “ডিসেন্ট ট্রেডার্স”র নাম আছে। সে (নুরুল হুদা) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এটা আমার কাছে দিয়েছিল।
সেই টাকাটা কাকে দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু জানেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে উপ-উপাচার্যের ভাগনে বলেন, উনি (নুরুল হুদা) আমাদের যেটা বলেছিলেন, উনার ডিপার্টমেন্টের টিচারকে পাঠিয়েছিলেন।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাকরিপ্রত্যাশী নুরুল হুদা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছবি: সেই রশিদ পাঠানো ম্যাসেঞ্জারের স্ক্রিনশট ও উপ-উপাচার্যের ভাগনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমান
প্রকাশিত ওই ফোনালাপে চাকরিপ্রত্যাশী নুরুল হুদার স্ত্রীকে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, মা (হুদার স্ত্রী), একটা কথা বলতো, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া যদি সেই রশিদের বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার জন্যই নুরুল হুদার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে থাকেন, তাহলে তার কাছে টাকা চাইলেন কেন?
জানা যায়, গত বছরের ১৩ নভেম্বর ওই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তার ২ দিন আগেই হুদা সেই ২ লাখ টাকার রশিদ পাঠান উপ-উপাচার্যের ভাগনে গাজী তৌহিদুর রহমানের কাছে। এর কয়েক দিন পর গত ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ অনুমোদন হয়। এর পরদিন ১৮ নভেম্বর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিভাগে যোগদান করেন।
তবে ওই নিয়োগে ভাগ্য খোলেনি নুরুল হুদার। যদিও তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে অনার্সে ৩.৬৫ ও মাস্টার্সে ৩.৬০ পান। আইন অনুষদে সেরা হওয়ায় ২০১৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান।
ছবি: চাকরিপ্রত্যাশী নুরুল হুদাকে উপ-উপাচার্যের ভাগনের ফোন দেওয়ার স্ক্রিনশট
ফোনালাপ প্রকাশের পর নুরুল হুদাকে ‘চাপ দেয়’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
গত ১ তারিখ ‘চাকরিপ্রার্থীর স্ত্রীর সঙ্গে রাবি উপ-উপাচার্যের দর-কষাকষি, ফোনালাপ প্রকাশিত!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে উপ-উপাচার্যের ভাগনে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমান ফোন করেন নুরুল হুদাকে।
এরপর নুরুল হুদা তাকে কলব্যাক করেন। সেদিন আবার সকাল ১১টা ৪ মিনিটে ২ বার নুরুল হুদাকে ফোন করেন উপ-উপাচার্যের ভাগনে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে আরেকটি নম্বর থেকে হুদাকে ফোন দেন তিনি। তখন ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা হয় তাদের। রাত ১০টা ৫৩ মিনিটে হুদার কাছে আবার ফোন করেন উপ-উপাচার্যের ভাগনে। এবার তাদের মধ্যে ৬ মিনিট ২ সেকেন্ড কথা হয়।
ফোন দিয়ে উপ-উপাচার্যের ভাগনে কী বলেছেন, জানতে চাইলে নুরুল হুদা বলেন, তার স্ত্রীকে নিয়ে ১ অক্টোবর সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনে আসতে বলেন উপ-উপাচার্যের ভাগনে। ওই ফোনালাপ মিথ্যা আখ্যা দিয়ে তাদের দুজনকে একটি বিবৃতি দেওয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু হুদা সেটা শোনেননি।
তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমান বলেন, এটা (ফোনালাপ প্রকাশের বিষয়টি) কেন হলো, সেই বিষয়ে জানার জন্য তাকে ফোন দিয়েছিলাম।
এ বিষয়ে জানতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
নিয়োগ পেয়েছেন যারা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৩টি প্রভাষক পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।
ওই নিয়োগে প্রভাষক পদে বিভাগে যোগদান করেছেন ফোনালাপ প্রকাশ হওয়া উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার মেয়ের জামাই সাইমুন তুহিন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর মেয়ে নূর নূসরাত সুলতানা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী বনশ্রী রানী।
সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়