মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
ছাত্রলীগের ছেলেরা আবরার ফাহাদকে মে’রে ফেলেছে। (তাকে কিভাবে মে’রেছে প্রথমে আমি সেটাও লিখেছিলাম কিন্তু মৃ’ত্যুর এই প্রক্রিয়াটি এত ভ’য়ঙ্কর এবং এত অবমা’ননাকর যে, বাক্যটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো আবরারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি প্রক্রিয়াটি না লিখি। দেশ-বিদেশের সবাই এটা জেনে গিয়েছে, আমার নতুন করে জানানোর কিছু নেই।)
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাকে আমার অনেক ছাত্রছাত্রীর মৃ’ত্যু দেখতে হয়েছে। তরুণ ছাত্রছাত্রীর মৃ’ত্যু বেশিরভাগ সময়েই অ’স্বাভাবিক মৃ’ত্যু দু’র্ঘটনায়, পানিতে ডু’বে কিংবা আত্মহ’ত্যা। রাজনৈতিক প্রতি’পক্ষের একজনকে প্রকাশ্যে পি’টিয়ে মে’রে ফেলার একটি ঘটনা ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় আবরারের হ’ত্যাকাণ্ডটি তার থেকেও ভ’য়ানক। তার কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই হ’ত্যাকাণ্ডের পর হ’ত্যাকারীরা পালিয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত এখনও পালিয়েই আছে। কিন্তু আবরারের হ’ত্যাকারী ছাত্রলীগের ছেলেরা পালিয়ে যায় নাই।
হ’ত্যাকাণ্ড শেষ করে তারা খেতে গিয়েছে, খেলা দেখেছে, মৃ’তদেহটি প্রকাশ্যে ফেলে রেখেছে। অপরাধীরা শা’স্তির ভ’য়ে পালিয়ে যায়, আবরারের হ’ত্যাকারীরা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করে না। সরকারের সমালোচনা করার জন্য তারা একজন ছাত্রকে ‘শিবির সমর্থক’ হিসেবে ‘যথোপযুক্ত’ শা’স্তি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলটি তাদের জন্য অনেক নিরাপদ জায়গা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তাদের দেখে শুনে রাখে, তাদের নিরাপত্তা দেয়। কেউ যেন মনে না করে এটি শুধুমাত্র বুয়েটের চিত্র, এটি আসলে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র, কোথাও বেশি, কোথাও কম।
হ’ত্যাকাণ্ডের পর আমরা আরও একটি নাটক দেখেছি সেটি হচ্ছে, ছাত্রলীগের নিজেদের একটি তদন্ত। একটি হ’ত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় অপরাধ, সরকার তার তদন্ত করে বিচার করবে, শা’স্তি দেবে, সেখানে অন্যরা কেন নাক গলাবে? আত্মবিশ্লেষণ করতে চায় করুক কিন্তু সেটি কেন গণমাধ্যমের মাঝে আমাদের জানতে হবে? শুধু তাই নয়, আমরা সবাই বুঝতে পারি একজন সন্তানের হ’ত্যাকাণ্ডের পর তার বাবা-মায়ের মনের অবস্থা কী থাকে। সেই সময় খুঁজে খুঁজে অপরাধীদের বের করে তাদের বিরু’দ্ধে মামলা করার মতো মনের অবস্থা থাকে না। আবরারের বাবা-মা তো তার সন্তানকে বুয়েটের শিক্ষকদের হাতে, প্রশাসনের হাতে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য তুলে দিয়ে এসেছিলেন। লা’শ হয়ে যাওয়ার জন্য দিয়ে আসেননি। এরকম একটি ঘটনার পর কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ব্যর্থতার দায়টুকু নিয়ে নিজেরা মামলা করার দায়িত্বটুকু নেয় না? বাবা-মা আপনজনকে এই অর্থহীন নি’ষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি দেয় না?
আমি ঠিক জানি না আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা জানেন কিনা, এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগের ওপর কতটুকু ক্ষু’ব্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতো আমার কোনরকম হে’নস্তা সহ্য করতে হয় না। কিন্তু তারপরও আমি যে কোন সময়ে চোখ বন্ধ করে তাদের বিশাল অ’পকর্মের লিস্ট তুলে ধরতে পারব। ছাত্রলীগের বিরু’দ্ধে এই ক্ষো’ভ ঘৃ’ণার পর্যায়ে চলে গেছে এবং দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যে কয়টি আন্দোলন হয়েছে তার সবই আসলে ছাত্রলীগের প্রতি ভ’য়ঙ্কর ক্ষো’ভের এক ধরনের প্র’তিক্রিয়া।
কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের সভাপতি সিলেটে এসেছিল। তখন যত মোটরসাইকেল দেখেছি, জীবনে আর কখনও এক সঙ্গে এত মোটরসাইকেল দেখিনি। এরা সবাই ছিল ছাত্রলীগের কর্মী। আমার প্রশ্নটি ছিল খুবই সহজ। একজন ছাত্র এখনও লেখাপড়া শেষ করেনি, তাদের আয়-উপার্জন থাকার কথা নয়। তাহলে তারা কেমন করে এত মোটরসাইকেল কিনতে পারে? ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড যদি শুধুমাত্র মোটরসাইকেল কেনার মাঝে সীমাব’দ্ধ থাকত, আমরা হয়ত সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু যখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা অবলীলায় তাদের একজন সহপাঠীকে নি’র্মম অ’ত্যাচার করে মে’রে ফেলে- কারণ তাদের বুকের ভেতরে আত্ম’বিশ্বাস আছে তাদের কিছুই হবে না, সেটা কারও পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। খুবই স্বাভাবিকভাবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষো’ভে ফেটে পড়েছে, এর আগে প্রত্যেকবার যখন এ রকম হয়েছে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর ঝাঁ’পিয়ে পড়েছে। এবারেও কি সেটা করার চেষ্টা করবে? তাদের এখনও কি সেই মনের জোর আছে?
খবরের কাগজে দেখলাম, বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় কুষ্টিয়ায় আবরারের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তার অনেক সাহস আমাদের এত সাহস নেই, আবরারের বাবা-মায়ের চোখের দিকে আমরা তাকাতে পারব না।
কেমন করে পারব? যে দেশে একজন ছাত্র নিজ দেশকে ভালবেসে নিজের মনের কথাটি প্রকাশ করার জন্য সহপাঠীদের হাতে নি’র্যাতিত হয়ে মা’রা যায়, কেউ তাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে না, সেই দেশের একজন মানুষ হয়ে আমরা কেমন করে মুখ দেখাব?
এই দেশে আমরা আর কতদিন এভাবে দা’নবের জন্ম দিতে থাকব?
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
291