ফিচার ডেস্ক:
সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের অবি’চ্ছেদ্য অংশ- ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কাপ্তাই লেকে এক সময় মিলত ৭৫ প্রজাতির মাছ। এই লেক পরিচিত ছিল রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের অ’ফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবেও। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, ততই ঐতিহ্য হারাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই কৃত্রিম লেক।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ বলছে, কাপ্তাই লেক থেকে এরই মধ্যে বিলু’প্ত হয়ে গেছে অন্তত ৯ প্রজাতির মাছ। বিপ’ন্নের পথে আছে আরও ১৮টি প্রজাতি। এই লেকের রুই, কাতলা আগে সারাদেশে গেলেও ১৩ বছরের ব্যবধানে সেই মাছের পরিমাণও ১১৯ টন থেকে কমে এসেছে মাত্র ৫ টনে। কাপ্তাই লেকের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তাই কাজ শুরু করছে বিশেষায়িত এক গবেষণা জাহাজ।
মাছ কমার কারণ চিহ্নিত করে উৎপাদন বাড়াতে এই জাহাজ কাজ করবে ১৫টি বিষয় নিয়ে। প্রায় ৪ কোটি টাকায় নির্মিত এই জাহাজের ভেতরেই আছে বিশেষ ল্যাব। মাছের উৎপাদন বাড়াতে এতে বছরজুড়ে গবেষণা চালাবেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এমএস ও পিএইচডি লেভেলের শিক্ষার্থীরা।
প্রসঙ্গত, মাছের উৎপাদন বাড়াতে দেশের কোনো লেকে বিশেষায়িত জাহাজ নিয়ে এভাবে গবেষণা করার উদ্যোগ এটিই প্রথম।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, নীল সবুজ শৈবাল ও ডায়াটম নামের এক ধরনের উদ্ভিদকণা প্রচুর পরিমাণে থাকায় কাপ্তাই লেকে কার্প জাতীয় মাছের ব্যাপক উৎপাদন ছিল। কিন্তু নানা কারণে এখন কার্প জাতীয় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মহাশোল, বাঘাইড়, পিপলা শোল, নান্দিনা, সিলন, দেশি সরপুঁটি, ঘাউরা, মোহিনী বাটা ও দেশি পাঙ্গাশ প্রজাতির মাছ এরই মধ্যে বিলু’প্ত হয়ে গেছে।
বিপ’ন্নপ্রায় মাছের মধ্যে রয়েছে- বাচুয়া বাচা, ভাঙন বাটা, সরপুঁটি, দেশি মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, গুলশা, সাদা ঘনিয়া, বাচা, কালিবাউশ ও ঘনিয়া। উৎপাদন ক্রমশ কমছে- রুই, কাতলা, মৃগেল ও বড় চিতল জাতীয় মাছের।
এ কারণে প্রধানমন্ত্রী কাপ্তাই লেকে মাছের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা শুরু করতে বলেছেন। এ জন্য প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বানানো হয়েছে বিশেষায়িত একটি জাহাজও। এই জাহাজে সারা বছর গবেষণা করবেন সিভাসুর মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশেষ এই মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে আমরা উদ্বোধনের জন্য সময় চেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর।
গবেষণা জাহাজ প্রকল্পের সার্বিক দায়িত্বে আছেন সিভাসুর মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম নুরুল আবছার খান। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া তাদের কৃত্রিম হ্রদ লেক কেনিয়রে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা চালিয়ে বিপন্ন প্রজাতির মাছের অভ’য়ারণ্য গড়ে তুলেছে। সেই হ্রদের আদলে কাপ্তাই লেকে নামছে ভ্রাম্যমাণ গবেষণা জাহাজ। এ জাহাজের মাধ্যমে লেকের মাছ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি তা সংরক্ষণে নানা উদ্যোগও নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) উদ্যোগে এ তরী তৈরি করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশে এটিই প্রথম।
জানা গেছে, অন্তত ১৫টি বিষয় নিয়ে লেকে নামবে এ গবেষণা জাহাজ। এর মধ্যে অন্যতম হলো লেকের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের হার বের করা, মাছের অভ’য়াশ্রম সৃষ্টির জন্য স্থান নির্বাচন, সময়ের সঙ্গে লেকের বিভিন্ন ভৌত রাসায়নিক পরিবর্তন বিশ্নেষণ করা, বিলু’প্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির পুনরু’দ্ধারের চেষ্টা, লেকে চাষযোগ্য সম্ভাব্য প্রজাতি বের করা, বিভিন্ন মাছের প্রজ’ননক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা নিরূপণ, প্রজ’ননক্ষেত্র ন’ষ্ট হওয়ার কারণ বিশ্নেষণ ও পদক্ষেপ নেওয়া, স্থানীয় জনশক্তিকে খাঁচায় ও পেন কালচারের মাধ্যমে মাছ চাষে উদ্যোগী করা, ঘোনায় মাছ চাষের সুবিধা ও অ’সুবিধাগুলো যাচাই।
এ ছাড়া লেকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের বিস্তৃতির বর্তমান অবস্থা নিরূপণ করা হবে। প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে নির্ধারণ করবে করণীয়। লেক ভরাট হওয়ার জন্য দায়ী কারণগুলো বিশ্নেষণ ও নিরূপণে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায়, তা নিয়েও কাজ করবে এই জাহাজ। লেকের পানি দূষণমুক্ত করতে করণীয় ঠিক করবে এ গবেষণা জাহাজ। এক কথায় এ ভ্রাম্যমাণ জাহাজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে কাপ্তাই লেক ও তার জীববৈচিত্র্যকে বিলু’প্তির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হবে।
জানতে চাইলে ডিন অধ্যাপক ড. এম নুরুল আবছার খান জানান, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্চ সাব স্টেশন ও অ্যাকুয়াটিক রিসার্চ গ্রুপের তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ১৯৬৫-৬৬ সালেও এই লেকে উৎপাদিত মাছের ৮১ শতাংশ ছিল কার্প জাতীয়। আর এখন যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার ৯২ শতাংশই হচ্ছে চাপিলা, কাঁচকি, তেলাপিয়া জাতীয় ছোট মাছ।
অথচ ১৯৬৬ সালে লেকে উৎপাদিত মাছের মধ্যে ছোট মাছের হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টরের এই লেকে প্রতি বছর ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন মাছ পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেখানে গড়ে মিলছে মাত্র ১০ হাজার টন মাছ।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই কৃত্রিম লেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৮ কিলোমিটার। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ১৯৬১ সালে এই লেক তৈরি হলেও এটি দেশের মাছ উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছিল। সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই গবেষণা জাহাজ নামানো হচ্ছে কাপ্তাই লেকে।