সময় এখন ডেস্ক:
রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অ’বৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
ঢাকার জুয়াড়িদের কাছে যিনি ক্যাসিনো খালেদ হিসেবে পরিচিত। এই জুয়াড়ি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে তার অপরাধ জগত সম্পর্কে নানা তথ্য। বেরিয়ে আসছে তার অতীতের সব অপরাধ।
ফ্রিডম পার্টির নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া সবশেষ যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবদলে যোগ দেন। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে পল্টি নেন। রাতারাতি বনে যান প্রভা’বশালী যুবলীগ নেতায়।
এই খালেদই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর হাম’লা চালিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা হ’ত্যাচেষ্টায় তিনি সরাসরি জড়িত। তবে মৃ’ত দেখিয়ে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। পরে জানা যায়, খালেদ মা’রা যাননি।
শেখ হাসিনাকে হ’ত্যার উদ্দেশে ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হাম’লা হয়। ওই হাম’লায় শীর্ষ সন্ত্রা’সী জাফর আহম্মদ মানিক, সৈয়দ নাজমুল মাহমুদ মুরাদ, পাগ’লা মিজান এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ সরাসরি অংশ নেয়।
এ ঘটনার ৮ বছর পর মানিক-মুরাদের সঙ্গে খালেদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে সূত্রাপুর থানার একটি হ’ত্যা মামলার সূত্র উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘খালেদ’ মা’রা গেছেন। কখন, কীভাবে সে মা’রা গেছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
এমনকি খালেদের পিতার নাম, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া গেছে বলা হলেও অভিযোগপত্রে এসব তথ্য নেই। খালেদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মোহাম্মদ আলীও বলেছেন, ওই হাম’লায় খালেদ সরাসরি অংশ নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর ২২ বছর পর অভিযোগ উঠল, হাম’লায় জড়িত খালেদ মা’রা যাননি। ওই মামলার বিচারকার্যও শেষ হয়ে গেছে।
২০১৭ সালে এই মামলার রায়ে খালেদের সন্ত্রা’সী ২ সহযোগী মানিক-মুরাদসহ ১১ জনের ২০ বছর করে সাজা হয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় খালেদ ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহি’ষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াই সেই খালেদ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সে ভোল পাল্টে যুবলীগের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তাকে আশ্রয় দেন যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। অর্থ ও ক্ষমতার জোরে যুবলীগের বড় পদও বাগিয়ে নেয়। পরে সেই ‘মৃ’ত’ খালেদই নগরবাসীর জন্য আত’ঙ্কে পরিণত হয়। আর এভাবেই উত্থান ঘটে ‘মৃ’ত’ খালেদের।
খালেদকে মৃ’ত দেখিয়ে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে সংস্থাটি।
এ ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে বলেও একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন। র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পিতভাবেই মামলার অভিযোগপত্র থেকে খালেদকে মৃ’ত দেখানো হয়েছে। অভিযোগপত্রে নাম না থাকায় তার বিচারও হয়নি।
খালেদের বাবা মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, তদন্ত এখনও সম্পন্ন হয়নি। শেষ হলে আমরা বিস্তারিত জানাতে পারব। এখনই এ বিষয়ে হ্যাঁ বা না বলার সময় আসেনি।
খালেদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মোহাম্মদ আলী বর্তমানে পলাতক। তিনি টেলিফোনে বলেন, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে হাম’লায় আমার ওস্তাদই তো (খালেদ) ছিলেন। তিনি যে ওই হাম’লায় জড়িত ছিল এটা আমরা জানি।
তিনি বলেন, একদিন খালেদের বাবা আইনজীবী মান্নান ভূঁইয়া আমাকে বলছিলেন, আমি যদি আইনজীবী না হতাম তবে খালেদের এসব মামলা কি গায়েব করতে পারতাম। আমি যখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলাম, সব ফাইল গায়েব করে দিছি।
আমি বললাম, খালু একটু কনতো ফাইল গায়েব করে ক্যামনে। তখন তিনি বলেন, তুমি উকিল হলে বুঝতা। বিএনপি ক্ষমতায় আসুক তোমাকে বুঝামু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালেদের বাবা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, এসব কথা ভিত্তি’হীন। তখন খালেদ ৯ম শ্রেণিতে পড়ত। সে কীভাবে ফ্রিডম পার্টি করে। এসব কথা কোথা থেকে আসে কীভাবে আসে বুঝতে পারি না। নথি গায়েব এমন কোনো কিছু নেই।
খালেদের সহযোগী আলীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মান্নান ভূঁইয়া বলেন, সে পালিয়ে চলে গেছে। পূর্বাচল থেকে পালিয়ে গেছে। এগুলো বলে তো আর লাভ নেই। আলী তার নাম। সে ক্রিমিনাল কেসের আসামি। সে অ’বৈধভাবে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছে।
শেখ হাসিনা হ’ত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, আমরাও শুনেছি খালেদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াই যে সেই খালেদ সেটা জানা ছিল না। সে কীভাবে দলে অনুপ্রবেশ করেছে তা তদন্ত হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের বিরু’দ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে অপ’সারণের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যুবলীগ নেতাদের বিষয়েও চরম ক্ষো’ভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যুবলীগের এক নেতা অ’স্ত্র উঁচিয়ে চলে। আরেকজন প্রকাশ্যে চাঁদা’বাজি করে বেড়ায়।
এরপর গণমাধ্যমে যুবলীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতায় ঢাকার ৬০টি জায়গায় ক্যাসিনো পরিচালনার খবর প্রকাশ হয়। ১৮ নভেম্বর ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স, ওয়ান্ডারার্স এবং গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ মদ ও ৪০ লাখের বেশি টাকা উদ্ধার করে র্যাব।
ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে ওই দিনই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
যেভাবে আসে খালেদের নাম:
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হ’ত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িতরা ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
হাম’লার আগে ধানমণ্ডির ফ্রিডম পার্টির অফিসে গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের নেতৃত্ব দেয় বঙ্গবন্ধু হ’ত্যাকাণ্ডে জড়িত লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ। ওই বৈঠকে শীর্ষ সন্ত্রা’সী মানিক, মুরাদ, তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদসহ ২০ জন উপস্থিত ছিল।
পরে হাম’লায় মানিক, মুরাদ, খালেদসহ ১২ জন ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার বাসায় দুটি ট্যাক্সিযোগে হাম’লা করে।
তদন্ত চলাকালে অভিযুক্তদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ ওরফে খালেক ওরফে খালেদ অলিভী এবং শহিদুল ওরফে খোকন মা’রা যাওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।