সময় এখন ডেস্ক:
র্যাব হেফাজতে জিজ্ঞাসা’বাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহি’ষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট। র্যাব জানতে পেরেছে, ঢাকার অন্তত ১০টি ক্লাবে অ’বৈধ ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট। এসব জুয়ার আখড়া থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন তিনি। তার কাছে অন্তত ৪০০-৫০০ কোটি টাকা রয়েছে। ক্যাসিনোবিরো’ধী অভিযান শুরু হওয়ার পর এসব টাকা সরিয়ে ফেলেছেন সম্রাট।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসা’বাদে সম্রাট জানিয়েছেন- ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি ও চাঁদা’বাজি থেকে তিনি প্রচুর টাকা বগলদাবা করেছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরো’ধী অভিযানের পর তিনি কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে নগদ টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কোথায়, কার কাছে রেখেছেন সে বিষয়ে কিছুতেই মুখ খুলছেন না সম্রাট।
তদন্তসংশ্লিষ্ট র্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সম্রাটের ক্যাশিয়ার হলেন- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহি’ষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক আরমান। ক্যাসিনো, চাঁদা’বাজি ও টেন্ডারবাজির টাকার বড় একটি অংশ আরমানের কাছে রাখতেন সম্রাট। সম্রাটের টাকা সম্পর্কে ও আরমানের কর্মকাণ্ড জানতে গত সোমবার আরমানকে ২য় দফায় ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে সম্রাটের ওই টাকার বিষয়ে জানার চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা র্যাব ১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, সম্রাট কোথায় ও কার কাছে টাকা রেখেছেন, সে বিষয়ে আরমানকে জিজ্ঞাসা’বাদ করা হচ্ছে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক এখন পর্যন্ত সম্রাটের বিরু’দ্ধে মামলা করেনি। দুদক সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত সম্রাটের মাত্র ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার নথিপত্র পাওয়া গেছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করলে কমিশন প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। কারণ যে বিপুল অর্থসম্পদ তার রয়েছে, সেই তুলনায় দুদকের পাওয়া এই তথ্য খুবই কম। তাই সম্রাটের আরও সম্পদের তথ্য বের করতে দুদক ২৪টি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে চিঠি দেবে।
সম্রাট ঢাকার অন্তত ১০ ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার হয়ে এগুলো দেখাশোনা করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বহি’ষ্কৃত সভাপতি মোল্লা কাওছার, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ, এনামুল হক আরমান ও কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ।
এদিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসা’বাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে চলেছেন সম্রাট। তার অ’বৈধ আয়ের সুবিধাভোগী হিসেবে অন্তত ২৫ জন প্রভাবশালী ব্যাক্তির নাম বলেছেন তিনি। এদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং প্রশাসনের কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
রমনা থানায় করা অ’স্ত্র ও মা’দক আইনের মামলায় সম্রাট ১০ দিন এবং তার সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। সোমবার তাদের রিমান্ডের ৬ দিন পার হয়েছে। র্যাব-১ কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসা’বাদ করা হচ্ছে।
ক্লাবগুলোতে অ’বৈধ ক্যাসিনো কারবার এবং চাঁদা’বাজি চালিয়ে যেতে প্রভাব’শালী সংসদ সদস্য, যুবলীগ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়মিত টাকা দিয়েছেন। এই সুবিধার বিনিময়ে তিনি কোনো সমস্যায় পড়লে তারা সহযোগিতা করতেন। তিনিও তাদের নাম ভাঙিয়ে চলতেন। র্যাবের জিজ্ঞাসা’বাদে এসব কথা বলেছেন সম্রাট। সুবিধাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭ জনকে ‘খুঁটির জোর’ বলে দাবি করেছেন তিনি।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, সম্রাট তার খুঁটি হিসেবে যাদের নাম-পরিচয় দিয়েছেন তারা হলেন- গোপালগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য (এমপি), যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভোলার এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, বর্তমানের এক এমপি যিনি আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) পূর্ব বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এবং মতিঝিল অপরাধ বিভাগের আরেকজন এডিসিকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিয়েছেন সম্রাট।
তার দাবি, এ ৭ জনই ছিলেন ক্যাসিনোসহ তার সব কারবারে খুঁটির জোর। সম্রাটের অ’পকর্মের সঙ্গে এই ৭ ব্যক্তির সম্পর্ক খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সম্রাটের বিপুল পরিমাণ টাকা পাচা’রের তথ্য পাওয়া গেছে। তার বিরু’দ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্র আরো জানায়, গ্রেপ্তারের পরই সম্রাট তার ৭ খুঁটির জোরের কথা বলেছেন। এরপর রিমান্ডে জিজ্ঞাসা’বাদেও একই ধরনের দাবি করেছেন। তিনি বলছেন, টাকা তো অনেকে খেয়েছে! আমি একা ফাঁসব কেন? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা (সাবেক) মাগুরার এক নেতাকে প্রতি মাসে টাকা দিতেন সম্রাট। ওই ‘ভাইয়ের’ সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে অনেকে তাকে সমীহ করত। সম্রাটের দাবি করা সেই ‘বড় ভাই’ এখন এমপি।
ক্যাসিনো কারবারে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের টাকার বড় ভাগটি নিতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা কাওছার। তাকে সেখান থেকে আয়ের ৩৫ শতাংশ টাকা পকেটে নেওয়ার ব্যবস্থা সম্রাটই করে দেন।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সম্রাট অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তার অ’বৈধ আয় থেকে ডোনেশন দিয়েছেন। অনেক ব্যক্তি তার কাছে গিয়ে টাকা নিয়ে এসেছেন। তবে অ’বৈধভাবে ক্যাসিনো চালাতে এবং চাঁদা’বাজি অ’ব্যাহত রাখতে তিনি কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়মিত ১০ লাখ থেকে অর্ধকোটি টাকা পর্যন্ত মাসে ‘নজরানা’ দিয়েছেন। এই তালিকায় সবার ওপরে গোপালগঞ্জের একজন প্রভাব’শালী এমপি, যার সঙ্গে সম্পর্ক আছে প্রকাশ করে প্রভা’ব দেখাতেন সম্রাট।
যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে টাকা দেওয়ার পাশাপাশি তার বিভিন্ন প্রয়োজনও মেটাতেন সম্রাট। কর্মী ও ক্যাডার সরবরাহ করার দায়িত্বও ছিল সম্রাটের। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনকে কখনো ‘বস’, কখনো ‘লিডার’ কখনো ‘গুরু’ বলে ডাকতেন সম্রাট।
কাকরাইলে তার দখ’ল করা ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের ৫ তলায় শাওনের জন্য আলিশান অফিস করে দেন সম্রাট। এ ছাড়া চাঁদা’বাজিসহ অনেক কাজে শাওনের সহায়তা নেন তিনি। শাওনও বিভিন্ন কাজে সম্রাটকে ব্যবহার করতেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবে কাউন্সিলর সাঈদের মাধ্যমে সংগৃহীত টাকার একটা অংশ যেত শাওনের হাতে।
গত মঙ্গলবার ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত দুই মামলায় সম্রাটের ৫ দিন করে ১০ দিন এবং আরমানের এক মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওই দিন বিকেলেই দুজনকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
বুধবার মামলার তদন্তভার র্যাবে হস্তান্তর করা হলে বৃহস্পতিবার আদালতের নির্দেশে দুজনকে জিজ্ঞাসা’বাদের জন্য র্যাব-১ কার্যালয়ে নেওয়া হয়। গতকাল ছিল সম্রাট ও আরমানের রিমান্ডের ৪র্থ দিন।
417