দিনাজপুর প্রতিনিধি:
বীর মুক্তিযো’দ্ধা ও তার ছেলের সঙ্গে অ’সৌজন্যমূলক আচরণের দায়ে দিনাজপুর সদরের এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) আরিফুল ইসলামকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। সোমবার সকালে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার অফিস।
দিনাজপুর সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযো’দ্ধা ইসমাইল হোসেন ছেলেকে অ’পমান করে চাকরি ছাড়া করার ক্ষো’ভে-দুঃখে মৃ’ত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করার কথা বলে যান। তার অসিয়ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মুক্তিযো’দ্ধার ছেলেকে অ’সন্মান করা সেই এসিল্যান্ডের বিচারের দাবি ওঠে। এমতাবস্থায় আজ সকালে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলো।
এদিকে আজ সকালে বীর মুক্তিযো’দ্ধা ইসমাইল হোসেনের কবর জিয়ারত করেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। এ সময় মুক্তিযো’দ্ধার ছেলে নূর ইসলামকে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম হাসপাতালে একটি চাকরি দেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার এসএম তরিকুল ইসলাম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি জিপ গাড়ি উপহার দিয়েছেন দিনাজপুর এম আবদুর রহিম হাসপাতালে। কয়েক দিনের মধ্যে গাড়িটি হাসপাতালে চলে এলে সে গাড়িটিই চালাবেন নূর ইসলাম।
এদিকে এক বীর মুক্তিযো’দ্ধাকে অসন্মানের ঘটনার প্র’তিবাদে সোমবার সকালে দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে মানববন্ধন করেছেন বীর মুক্তিযো’দ্ধারা। এর আগে এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলামকে অবা’ঞ্ছিত ঘোষণা করে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জয়নুল আবেদিন ও সদর এসিল্যান্ডকে অবিলম্বে অপ’সারণের দাবি জানিয়েছিল জেলা মুক্তিযো’দ্ধা সংসদ।
জানা গেছে, দিনাজপুরের এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) অফিসে অস্থায়ী ভিত্তিতে মুক্তিযো’দ্ধার ছেলে নূর হোসেন গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গাড়িচালক পদে চাকরি পান। চাকরি নেয়ার পর থেকেই দিনাজপুরের এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নিজ বাড়ির বাজার করিয়ে নিতেন। বাড়ির যাবতীয় অন্যান্য কাজও করিয়ে নিতেন তাকে দিয়ে। এমনকি বাড়ির রান্না ও শৌচাগারও পরিষ্কার করিয়ে নিতেন। সম্প্রতি নূর ইসলাম কোনো অপরাধ না করলেও তাকে গাড়িচালক পদ থেকে বরখা’স্ত করেন এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলাম।
একজন মুক্তিযো’দ্ধা হয়েও ছেলের এমন অ’পমান সইতে পারছিলেন না ইসমাইল হোসেন। মৃ’ত্যুর আগে তিনি একটি চিঠি লিখে গেছেন, ‘অ’স্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সে দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অ’ন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হলো! এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি আমার ছেলেকে চাকরি ও বাস্তু’চ্যুত করে পেটে লাথি মে’রেছে। তাই মৃ’ত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ হিসেবে তাদের স্যালুট আমার শেষ যাত্রায় চাই না।’
বুধবার বেলা ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা’রা গেলে চিঠিতে উল্লেখ করা ‘শেষ ইচ্ছা’ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ইসমাইল হোসেনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়। এ সময় ‘গার্ড অব অনার’ দিতে আসা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের ফিরিয়ে দেন ইসমাইল হোসেনের স্বজন-পরিজনরা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ে বিউগলে বাজেনি বিদায়ের সুর। এমনকি তার ডেডবডি জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিতও করা হয়নি।
পরিবার ও স্বজনরা জানান, মঙ্গলবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি চিঠি লিখেন মুক্তিযো’দ্ধা ইসমাইল হোসেন। পরে এর নিচে সইও করেন। ওই দিনই তা ডাকযোগে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের ঢাকার ঠিকানায় পাঠানো হয়। এর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার বেলা ১১টায় মা’রা যান জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তান।
গার্ড অব অনার দিতে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে ইসমাইল হোসেনের ছেলেরা বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বেতন পান। একজন বীল মুক্তিযো’দ্ধার প্রতি এমন অ’বহেলা, এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে। এ কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্র’ত্যাখ্যান করেছেন।
জানা গেছে, মুক্তিযো’দ্ধা ইসমাইল হোসেনের ২য় ছেলে নূর হোসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ড্রাইভার পদে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাকরি করতেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে ২০১৭ সালে তার চাকরি হয়। নূর হোসেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুল ইসলামের গাড়ি চালাতেন। সম্প্রতি ছেলেকে চাকরি’চ্যুত করা হলে ইসমাইল হোসেন মানসিকভাবে ব্য’থিত হন।
৮০ বছর বয়সী এই বীল মুক্তিযো’দ্ধা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসক’ষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। বুধবার শারীরিক অবস্থার অ’বনতি হলে তাকে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন ছেলেরা। সেখানেই তিনি আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন।
চিঠিতে ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করেন, তার ছেলে নূর হোসেনকে দিয়ে ভূমি কমিশনার বাসার রান্নাসহ বিভিন্ন কাজ করাতেন। সামান্য কারণেই কমিশনার ছেলের সঙ্গে দু’র্ব্যবহার করতেন। অফিসে যেতে দেরি করায় এবং বাসার শৌচাগার পরিষ্কার করতে রাজি না হওয়ায় গত আগস্টে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়া হয়। তিনি ঈদগাহ বস্তি এলাকায় সরকারি একটি পরিত্য’ক্ত বাসায় থাকতেন। পরে সেখান থেকেও নূর হোসেনকে বের করে দেয়া হয়। চাকরির পর বাসা থেকেও উ’চ্ছেদ হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেশ ক’ষ্টে দিনযাপন করছেন নূর হোসেন।
এদিকে বীর মুক্তিযো’দ্ধার প্রতি অবহেলা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়া দাফনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার। ওই কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেন জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে সরকার সচেতন। তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবে তাদের বিরু’দ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।