বিশেষ সংবাদদাতা:
সময়টা ২০০৫ সালের ৮ মে। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান ঘোষণা দিলেন, টাটা বাংলাদেশে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। যা হবে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী টাটা এখানে সার আর ইস্পাত কারখানা করতে আগ্রহী। শর্ত মতে বাংলাদেশ নির্ধারিত মূল্যে ২৫ বছরের জন্য নিরব’চ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করবে টাটাকে। মিডিয়ায় দেয়া সেই ঘোষণার সময় টাটা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত জ্বালানি উপদেষ্টার ছবি এলো পত্রিকায়।
প্রাথমিক এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলল। গ্যাসের মূল্য নিয়ে চলল দর কষাকষি। টাটা বিকল্প প্রস্তাব দিল। প্রতি ঘনফুট ৩.১০ মার্কিন ডলার হিসেবে গ্যাসের দাম নির্ধারিত হলো সার কারখানা প্রকল্পের জন্য। আর ইস্পাত কারখানার জন্য ২.৬০ ডলার। সংশোধিত প্রস্তাবে টাটা বাংলাদেশ সরকারকে ১০% মালিকানা দেবারও প্রস্তাব করল। আলোচনা চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাল। জ্বালানি উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যে তারা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করবেন।
এরই মধ্যে খবর এলো, তারেক রহমান টাটার উচ্চ পদস্থ প্রতিনিধিদের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করতে চান। টাটা কর্তৃপক্ষ খুশিই হলো। তবে তারেকের ইচ্ছা বৈঠক হবে ভারতে। টাটার তখন সর্বোচ্চ কর্তা রতন টাটা। রতন টাটা আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানালেন তারেক রহমানকে। তারেক জানালেন তিনি একা নন, তার সঙ্গে যাবেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন (প্রকাশ খাম্বা মামুন) এবং সিলভার সেলিম।
টাটা কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল সরকারি কর্মকর্তারা আসবেন তারেকের সাথে। কিন্তু এদেরকে তো কেউ চেনে না! ঢাকাস্থ ভারতীয় দুতাবাস জানাল, এরা তারেকের ব্যবসায়িক পার্টনার।
আমন্ত্রণ পেয়ে তারা ৩ জনই গেলেন টাটার সদর দপ্তরে। রতন টাটা তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে তারেক জানালেন, তারা একান্তে রতন টাটার সঙ্গে কথা বলতে চান। টাটার বোর্ড মেম্বাররা উঠে গেলেন।
একান্তে কথা বলার সময় তারেকের পাশ থেকে বন্ধু ও পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুন সরাসরি প্রশ্ন করলেন- আমাদের কমিশন কত? রতন টাটা প্রথমে বুঝতে পারলেন না। তাকে এবার আরও স্পষ্ট করা হলো। রতন টাটা মনে করলেন তরুণরা বোধহয় তার সঙ্গে রসিকতা করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার ভুল ভাঙল।
রতন টাটা সাফ জানিয়ে দিলেন, এ ধরনের কমিশন দেওয়ার কোনো সিস্টেম টাটার নেই। টাটার বিস্তৃতি বিশ্বব্যাপী। সর্বত্রই টাটা তার সুনাম নিয়ে কাজ করে। ঘুষ বা কমিশন টাটার রীতি বিরু’দ্ধ।
তবুও নাছোড়বান্দা তারেক বললেন, বাংলাদেশ সরকারকে ১০% মালিকানা দেওয়া হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে? রতন টাটা জানালেন এটি ইকুইটি পার্টিসিপেশন। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এটা অ-পরিহার্য শর্ত। তারেক দাবি করলেন ওই ১০% গিয়াসউদ্দিন মামুনের ওয়ান লিমিটেডের নামে দিতে হবে।
রতন টাটাও ঝানু ব্যবসায়ী, দেখতে চাইলেন এদের দুর্নীতির গভীরতা কতটুকু। সরাসরি জানতে চাইলেন, তোমাদের ডিমান্ড কী, অ্যাট এ গো তোমরা কত চাও?
মামুন: ২০০ কোটি ডলার এখন আর নির্বাচনের সময় ১০০ কোটি ডলার। রতন টাটা: কীভাবে নেবে?
মামুন: আমাদের বিদেশে অ্যাকাউন্ট আছে, সেখানে। রতন টাটা: কোন দেশে? মামুন: দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া।
রতন টাটা সবগুলো ব্যাংক ডিটেইলস চাইলেন। মামুন, তার ব্রিফকেস থেকে কাগজ বের করলেন। রতন টাটা কাগজটা নিয়ে জানালেন, সি ইউ সুন’। বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তারেক জানালো, প্রথম পেমেন্ট ক্লিয়ার হবার পরই এমওইউ সাইন হবে। রতন টাটা করমর্দনের হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘অফকোর্স’।
৩ জনকে বিদায় দিয়ে, বৈঠকের কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট তৈরি করলেন রতন টাটা। ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঠানো হলো গোপন নোট। আর এই নোট যেদিন দিল্লিতে পাঠানো হলো, সেদিনই টাটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করল।
রতন টাটার ওই নোট শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পর্যন্ত গিয়েছিল।