১২টি কমোড ক্রয়ে ১১ লাখ টাকা: চট্টগ্রাম বন গবেষণাগারে হরিলুট!

0

চট্টগ্রাম ব্যুরো:

একটি ইংলিশ কমোডের বাজার মূল্য ৬ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু এমন ১২টি কমোড চট্টগ্রাম বন গবেষণা ইনস্টিটিউট কিনতে ব্যয় দেখিয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার ৯২০ টাকা। হিসেব করলে দেখা যায় একটি কমোডের মূল্য ধরা হয়েছে ৯০ হাজার ৯১০ টাকা।

একইভাবে ১৯শ’ স্কয়ার ফিটের শুধুমাত্র একটি বাসায় টাইলস লাগানোর জন্য ব্যয় দেখানো হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ টাকা। যদিও টাইলস দেখে বাজার দর যাচাই করে দেখা যায় ক্রয় ও ফিটিংসে সর্বোচ্চ খরচ হওয়ার কথা মাত্র দেড় লাখ টাকা। কিন্তু তার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি দেখানো হয়েছে তাতে। এমন ৪টি বাসার চিত্র ছিল একই।

চট্টগ্রাম বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিত্যক্ত ৪টি বাসা মেরামতে সরকারি টাকা হরিলুটের এই দৃশ্য পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। বিষয়টি নজরে এসেছে স্বয়ং দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকেরও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পশ্চিম পাহাড়ে অবস্থিত ৪টি বাসা অ-স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডকে ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার জন্য প্রতিমাসে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট পাবে ২৬ হাজার ৮০৪ টাকা করে। তবে এসব বাসা পরি-ত্যক্ত থাকায় তা সংস্কার করে রাবার বোর্ডকে বুঝিয়ে দিতে সিদ্ধান্তও নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সংস্কারের নামেই এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই লোপাট হয়েছে সরকারি অর্থ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, একটি বাসায় ছাদ মেরামত, পানি, বিদ্যুৎ, স্যানিটারি, রঙ, টয়লেট, জানালা মেরামতের ব্যয় দেখানো হয় ২১ লাখ ২২ হাজার ২৯৮.৯৮ টাকা। একই ধরনের কাজে ৪টি বাসার ব্যয় দেখানো হয় ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৯৫ টাকা ৯২ পয়সা। এর বাইরে ৪টি বাসার পাশে গার্ডেনিং কাজের জন্য ব্যয় দেখানো হয় ৭ লাখ ৯২ হাজার ২২৭ টাকা। ২টি গ্যারেজ মেরামতের ব্যয় দেখানো হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৪০৪ টাকা। বাসাগুলোর চারপাশে নিরাপত্তার জন্য বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য ব্যয় দেখানো হয় ৩১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৮৩ টাকা।

এই ৪টি বাসা মেরামতের ব্যয়ের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ৪টি বাসার ছাদ মেরামতের কাজে বন গবেষণা কর্তৃপক্ষ ব্যয় দেখিয়েছে ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৪ টাকা। যদিও রাবার বোর্ডকে বুঝিয়ে দেওয়া বাসায় এখনো বৃষ্টির পানি পড়ছে। একইভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও স্যানিটারি বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১১ লাখ ৪২ হাজার ৩৬১ টাকা। তেমনি ১৯শ’ স্কয়ার ফিটের একটি বাসায় রঙের কাজের ব্যয় দেখানো হয় ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৬ টাকা। টাইলস ও অন্যান্য কাজে ব্যয় দেখানো হয় ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ১২০ টাকা। জানালা মেরামত কাজে ব্যয় দেখানো হয় ৯ লাখ ১ হাজার ৯৮৮ টাকা। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় সর্বোচ্চ এই ৪টি বাসায় খরচ হওয়ার কথা ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের ব্যয়ের তথ্য রীতিমত চমকে উঠার মত।

গত জুলাই মাসে ৪টি বাসা মেরামত বাবদ সর্বমোট ১ কোটি ২৯ লাখ ৯৮ হাজার ১১৬ টাকা ব্যয় দেখিয়ে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হলেও শুধুমাত্র ই-১১ নম্বর বাংলোটিই মেরামত করে বুঝিয়ে দিয়েছে রাবার বোর্ডকে। সম্পূর্ণ টাকা জলবায়ু তহবিল থেকে খরচ করা হয়। যদিও বন গবেষণা কর্তৃপক্ষ বলছেন এগুলো তাদের নিজস্ব তহবিলের টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট সুত্র বলছে মেরামতের নামে জলবায়ু ফান্ডের এসব টাকা হরিলুট করেছে বন গবেষণা কর্তৃপক্ষ।

গত ৩ সেপ্টেম্বর মেরামত করা একটি বাসাতেই অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু করেছে রাবার বোর্ড।

বাকি বাসাগুলো এখনও পড়ে আছে আগের মতো। হয়নি গ্যারেজ মেরামত কিংবা অন্য কাজও। অথচ তথ্যমতে গত জুলাই মাসেই এ ৪টি বাসা মেরামত ব্যয় দেখিয়ে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করেন বন গবেষণা কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাবার বোর্ডকে বুঝিয়ে দেওয়া বাসার দরজায় যে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো কাঁচা ও নিম্মমানের। যার কারণে দরজা খোলা ও বন্ধ করতেও রীতিমত সমস্যায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। একটি বাসার ছোট-বড় ১৩টি জানালা মেরামতে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪৯৭ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও জানালার গ্রিল আগে থেকেই রয়েছে। শুধুমাত্র তাতে রঙ ও গ্লাস লাগিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয়। রঙের কাজে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ টাকা দেখানো হলেও কোন কোন স্থানে খসে পড়ছে তা। ছাদ মেরামত বাবদ ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬৫১ টাকা দেখানো হলেও রান্না ঘরে বৃষ্টি হলে পানি পড়ে বলে জানান রাবার বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

এমন ব্যয়ের বিষয়ে জানতে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের নির্বাহী কর্মকর্তা নাদিম সরোয়ারের কার্যালয়ে যাওয়া হলে তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি এ ব্যাপারে বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর আলমের সাথে কথা বলতে বলেন।

পরে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে না পাওয়ায় পুনরায় নাদিম সারওয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত কোন টাকাই মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পায়নি। কিন্তু টাকা না পেয়ে একটি বাসার কাজ কীভাবে করা হলো- জানতে চাইলে তিনি পরে আসতে বলেন এবং এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

যদিও মেরামতের এসব টাকা বিভাগীয় কর্মকর্তা প্রশাসন জাহাঙ্গীর আলমের স্বাক্ষরে বন গবেষণার বেতনের টাকার সাথে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছে বলে দায়িত্ব পালনকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছবি বড়ুয়ার একটি অডিও ফোন আলাপে এ তথ্য জানা যায়। তবে এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে ছবি বড়ুয়া সংবাদপত্রের পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে ফোন বিচ্ছি’ন্ন করে বন্ধ করে দেন। সর্বশেষ অন্য নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অ-সংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। একপর্যায়ে ‘৯৯৯’ এ অভিযোগ করারও হুম’কি দেন তিনি।

বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব কাজ করেছেন নাদিম সারওয়ার। তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। না জানলে ব্যয়ের প্রাক্কলনে তার স্বাক্ষর কীভাবে এসেছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে দেওয়া হয়েছে, আমি স্বাক্ষর করেছি। এর বাইরে কিছুই জানি না’। সর্বশেষ তিনি প্রতিবেদককে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষে নিয়ে যান। তার সাথেই এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বলেন।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘বিষয়গুলো আমি দায়িত্ব পাওয়ার আগের ঘটনা। আমি এর কিছুই জানি না। এসব ছোটখাট বিষয় নিয়ে নিউজ না করারও অনুরোধ করেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘বন গবেষণার অনেক উন্নয়ন কাজের নিউজ আছে। সেসব করেন’।

কিন্তু দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলেও তিনি তার অধীনস্থ কর্মকর্তা নাদিম সারওয়ারের সাথে কথা বলতে বলেন। এ বিষয়ে তিনিও কিছু জানেন না বলে জানান।

ড. মাসুদুর রহমানের সামনেই নাদিম সারওয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন সবকিছুই প্রশাসন অফিসে রয়েছে। আমি বাইরে আছি। এখন কথা বলতে পারবো না।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!