আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
এক পাকিস্থানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সম -কা-মী নারীর সাথে বিবিসি’র সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ। বিবিসি তার পরিচয় প্রকাশ করেনি। তার ছদ্মনাম দেয়া হয় মরিয়ম। তিনি যে লেস-বিয়ান – সেটা তিনি তার পিতামাতার কাছে গোপন রেখেছিলেন। ভ’য়ে।
শেষ পর্যন্ত ভ’য় কাটিয়ে তিনি যখন বাবা মায়ের কাছে বিষয়টি খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিলেন – তখন ভেবে পাচ্ছিলেন না যে তিনি ঠিক কিভাবে বলবেন।
প্রথম কারণটা ছিল ভাষার সমস্যা। কারণ লেস-বিয়ান শব্দটির জন্যে পাঞ্জাবি বা উর্দু ভাষায় উপযুক্ত কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তিনি বলতে পেরেছিলেন যে যৌ’নতার ব্যাপারে পুরুষের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই।
এর মধ্য দিয়ে তার “দ্বৈত জীবনের” অব-সান হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরিবারের সাথে তার বিরো’ধ এতোটাই চরমে গিয়ে পৌঁছালো যে এক পর্যায়ে পিতা তাকে পরি’ত্যাগ করলেন।
“আমি সবসময়ই বুঝতে পারতাম যে অন্য নারীদের প্রতিই আমি আকৃষ্ট হচ্ছি। আমার বয়স যখন ৪/৫ বছর তখন থেকেই। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে চুমু খাওয়ার সময় আমি এটা টের পেয়েছি।”
তিনি বলেন, “কিন্তু এ বিষয়ে আমি তৎপর হতে শুরু করি কলেজে ওঠার পর থেকে। আমাদের বাড়িতে তখন ইন্টারনেট ছিল। আমার ভাইয়ের ঘরে ছিল একটা ডায়াল-আপ কম্পিউটার। ওই ঘরটা তালামারা থাকতো।”
“ইয়াহুতে গিয়ে আমি চ্যাট করতাম। আমার মনে আছে, কখনও কখনও আমি একজন পুরুষের ভান করতাম। কারণ আমি আসলে আরেকজন নারীর সাথে কথা বলতে চাইতাম। আমার বয়স যখন ১৮/১৯ – তখন আমি ভাবলাম, আমার একজন সম -কা-মী নারীকে খুঁজে বের করতে হবে।”
পাকিস্থানি পিতা মাতার সন্তান মরিয়মের জন্ম যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল শহরের একটি মুসলিম পরিবারে। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। মুসলিম রীতিনীতি খুব কঠোরভাবেই মানা হতো সেখানে। পরিবারের সবাই ৫ ওয়াক্ত নামাজও পড়তো।
খুব অল্প বয়স থেকেই মরিয়ম জানতেন তিনি যে একজন সম -কা-মী সেটা তার পরিবারের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। কারণ পরিবারের সদস্যরা যদি একথা জেনে যায় তখন তাকে কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে।
এটা গোপন রাখার জন্যে তাকে অনেক কিছুই করতে হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরে যে তাড়না ছিল সেটা তিনি প্রকাশ করতেন ইন্টারনেটে অন্য নারীদের সাথে চ্যাট করে।
তারপর যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন, তখন তিনি মনে মনে সাহস পেলেন অন্য নারীদের সাথে সরাসরি দেখা করার ব্যাপারে। সেটা করতে তিনি কয়েকশো মাইল দূরেও চলে যেতেন – যাতে তিনি তার পরিচিত কারো চোখে না পড়েন।
“আমি ম্যানচেস্টারেও চলে যেতাম। যেসব জায়গায় যেতে দু’ঘণ্টার মতো সময় লাগে সেসব জায়গায় চলে যেতাম।”
“আমি যে শহরে থাকি সেখানে আরেক নারীর সাথে সম্পর্ক করার ব্যাপারে আমি খুব ভ’য়ে থাকতাম। কেউ যদি আমাদেরকে একটা স্টেশনে দেখে ফেলে তখন কী হবে- এরকম একটা দৃশ্য সবসময় আমার মাথায় ঘুরপাক খেতো।”
কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার এই ভ’য় থেকেই যেন স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিলেন মরিয়ম। তিনি চলে যেতেন দূর দূরান্তে।
“আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম আমার শরীরের কোথাও যাতে এমন কোন চিহ্ন না থাকে যা দেখে আমার পরিবার আমাকে সন্দেহ করতে পারে। আমি আমার বান্ধবীকে সবসময় বলতাম তারা যেন আমার গলায় লাভ-বাইটের মতো কোন দাগ না দেয়।”
“কিন্তু আমি যখন দূরে কোথাও বান্ধবীর সাথে থাকতাম তখন আমি খুব উত্তে’জনা বোধ করতাম। আমি ভাবতাম – আমি এ রকম করতে পারছি! যাকে আমি চাই সে রকম একজন নারীর সাথে আমি যৌ’ন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছি!”
“সে সময় আমি যাদের সাথে মিশেছি তারা কেউ আমি যে এতো দূর থেকে আসি সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করতো না। একজন নারী ছিল – যার সাথে আমি ১ মাস পর পর দেখা করতাম। ট্রেনে করে যেতাম, তার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটাতাম, একটা পাবে যেতাম, খাওয়া দাওয়া করতাম। আমার তখন নিজেকে খুব স্বাধীন একজন মানুষ বলে মনে হতো।”
১ বছর ধরে তিনি বার্নলিতেও গিয়েছেন আরো একজন আরব মুসলিম নারীর সাথে মিলিত হতে। ওই নারী বিবাহিত ছিলেন। তার সন্তান সন্ততিও ছিল।
“রাস্তার পাশে আমি একটা হোটেলে গিয়ে থাকতাম। ওই মহিলার স্বামী রাতে কাজ করতেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তিনি কাজে চলে যেতেন। আমি তখন পেছনের দরজা দিয়ে তার বাড়িতে যেতাম। একটা অ্যালার্ম দেওয়া থাকতো যা ঠিক ভোর সাড়ে ৫টায় বেজে উঠতো। তখন ওই পেছনের দরজা দিয়েই আমি ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে আসতাম। তার পরিবার আমাকে ঠিকই চিনতো জানতো, কিন্তু তারা মনে করতো যে আমি ওখানে শুধু বেড়াতে যাচ্ছি।”
এই বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েই মরিয়ম একবার তার প্রেমিকাকে ব্রিস্টলে তার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
“সেও একজন মুসলিম ছিল। অন্য কেউ হলে হয়তো একটু অসুবিধা হতো। কিন্তু সে দেখতে যেহেতু এশীয় নারীদের মতো সে কারণে আমি তাকে খুব সহজেই বাড়িতে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কোন শ্বেতাঙ্গকে নেওয়া এতোটা সহজ হতো না।”
“আমার ঘরে দুটো বিছানা ছিল। আমার বাবা মা কখনো আমার ঘরে আসতো না। ফলে আমরা দু’জন আসলে এক বিছানাতেই থাকতে পারতাম। সেখানে আমি তখন নতুন এক দুনিয়া আবিষ্কার করি।”
“কিন্তু একটা সময়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিল। এই পরিকল্পনা তার আগে থেকেই ছিল। সে তখন সৌদি আরবে তার বাড়িতে চলে যায়। আমার জন্যে এটা খুব কষ্টের ব্যাপার ছিল।”
মরিয়মের বয়স যখন ২১ – তখন তিনি একজন সঙ্গী খুঁজে পেলেন। তিনি চাইছিলেন বিষয়টা তার পরিবারের কাছে খোলাসা করতে কিন্তু তিনি এটাও জানতেন যে এই অভিজ্ঞতা খুব ভালো কিছু হবে না।
“আমার মা বললেন যে তিনি কোনদিন ভাবেন নি তার কোন সন্তান এরকম হতে পারে। কেউ তাদের জন্যে এতো লজ্জার কারণ হয়ে ওঠতে পারে যেটা আমি করেছি। তিনি বললেন আল্লাহ নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন- তুমি যদি কোরানের কোন সুরা পড়ো তাহলে দেখবে যে সেখানে কখনো স্বামীর সাথে স্বামী কিম্বা স্ত্রীর সাথে স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা হয়নি।”
“আমি জানতাম যে আমার মা একটা বুদবুদের ভেতরে বসবাস করছেন। স-ম কা-মিতা সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু কন্যার জন্যে তার যে ভালবাসা তার সাথে তার সমাজের ও সংস্কৃতির একটা ল’ড়াই শুরু হয়ে গেল। তিনি খুব দু’শ্চিন্তায় পড়ে গেলেন – কারণ আমি একটা গুনাহগার জীবন যাপন করছি। তিনি এতো ক’ষ্ট পাচ্ছিলেন যে আমি তার মুখের দিকেও তাকাতে পারতাম না।”
মরিয়মের সঙ্গে তখন তার পরিবারের সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে গেল। এর ৬ মাস পর যা হলো সেটা এরকম – বাড়িতে শুধু চিৎকার, চেঁচা’মেচি ও কান্না’কাটি।
এক পর্যায়ে তিনি তখন বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু মরিয়মের মা এই বিষয়টা গোপন রাখতে রাজি হলেন।
কিন্তু এই বিষয়টা পিতাকে জানাতে মরিয়মের সময় লাগলো ১ দশকের মতো। তখন তিনি তার সঙ্গীর সাথে সম্পর্কে জড়িত হয়েছেন এবং তখনই তিনি মনে করলেন যে পিতাকে জানানোর জন্যে এটাই সবচেয়ে ভাল সময়।
“আমি যতোটুক পাঞ্জাবি বা উর্দু ভাষা জানি তাতে লেস-বিয়ান শব্দটির কোন অনুবাদ ছিল না। আমি তখন তাকে বললাম, আপনার সাথে আমার মায়ের যে ধরনের সম্পর্ক, তার সাথেও আমার ওই একই ধরনের সম্পর্ক।”
“তিনি তখন বললেন, ‘তুমি তো ইসলাম সম্পর্কে জানো, তুমি মসজিদেও গিয়েছ, কোরান পড়েছ, তুমি তো জানো যে কোনটা গুনাহর কাজ আর কোনটা নয়। আমি যতো দূর জানি তাতে তুমি ভুল এবং আমিই সঠিক। তুমি যা করছো সেটা ইসলামের বিরো’ধী।”
মরিয়ম বললেন যে তার পিতা তখন তার সামনে দুটো পথ তুলে ধরলেন- সঙ্গীকে ছেড়ে দিয়ে পরিবারের বাড়িতে ফিরে আসা অথবা বাড়ির চাবি ফিরিয়ে দিয়ে আর কখনো এই বাড়িতে না আসা যাতে তাদেরকে তার মুখটাও দেখতে না হয়।
“তিনি তখন আমার কোন কথাই শুনলেন না এবং আমাকে পরি’ত্যাগ করলেন।”
শুরুতে তিনি তার মায়ের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেন। যদিও মরিয়ম এখনও চান যে তাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকুক। এরপরেও তার বোনের বাড়িতে তাদের কখনও কখনও দেখাও হয়েছে।
“আপনি যখন ধর্ম থেকে, সংস্কৃতি থেকে এবং তাদের অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসেন, তারপরেও আপনাকে মনে রাখতে হবে যে তিনি আমার মা এবং আমি তার মেয়ে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ছিল এরকম যে ‘আমি ঠিক, সে ভুল’, সেটা তখন শাদা ও কালোর মতো ছিল, কিন্তু এখন ব্যাপারটা আমার কাছে ধূসর। আমার মা যেভাবে ভাবছেন সেখানে তিনি ঠিকই আছেন। আবার আমি যেভাবে ভাবছি সেখানে আমিও ঠিক আছি।”
সম্প্রতি পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে পিতার সাথেও মরিয়মের দেখা হয়েছে।
“তার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্যে আমি এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছি। তিনি যখন কাজের জন্যে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমি তার কাছে গেলাম। তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি ছিলেন অ’নড়। কিন্তু আমি আরো ১০ সেকেন্ডের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কারণ আমি আমার পিতাকে খুব মিস করছিলাম।”
ইসলামের মতো খ্রিস্টান এবং অর্থোডক্স ইহুদি ধর্মেও স-ম কা-মিতাকে দেখা হয় পাপ হিসেবে। কোন কোন ধর্মে এই বিষয়টিকে গ্রহণ করে নেওয়ারও একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। তবে ইসলাম এবং অর্থোডক্স চিন্তাভাবনাতে এর কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
মরিয়মের বান্ধবী একজন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ। তাদের ইচ্ছা ২০২০ সালে বিয়ে করা।
মরিয়ম মনে করেন, তার সমাজের অনেকেই আছেন যারা একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস না করে বসবাস করছেন অষ্টম শতাব্দীতে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, একজন মুসলিম হয়েও সম -কা-মী নারী হওয়া যায়।
303