সময় এখন ডেস্ক:
পুত্র ড. অভিজিৎ রায় জ’ঙ্গি হাম’লায় নিহ’ত হওয়ার পর ভেঙে গিয়েছিল মন, সেই শোক সইতে না পেরে স্ত্রীও গত হয়েছিলেন বছর খানেক আগে; অভিজিৎ রায় হ’ত্যার বিচার শেষ হওয়ার আগেই এবার চির বিদায় নিলেন তার বাবা বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও বীর মুক্তিযো’দ্ধা অধ্যাপক ড. অজয় রায়।
আজ সোমবার, ৯ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃ’ত্যু হয় বলে হাসপাতালের পরিচালক শহীদুল হক মল্লিক জানান।
শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযো’দ্ধা ড. অজয় রায়ের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
জ্বর ও শ্বাসক’ষ্ট নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর থেকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়। ধীরে ধীরে শ্বাসক’ষ্ট বাড়লে ২ দিন পর থেকে তাকে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়া হচ্ছিল।
শিক্ষা ও কর্ম জীবন
ড. অজয় রায় স্কুল এবং কলেজ জীবনে পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাশ করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ১৯৬৭ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। দেশি এবং বিদেশি বহু জার্নালে তার পেপার প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি পদে আসীন ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদক। তিনি ছিলেন শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং দক্ষিণ এশীয় মৌ’লবাদ ও সাম্প্রদা’য়িকতাবিরো’ধী সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং মুক্তান্বেষার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কলামিস্ট হিসবেও তিনি দৈনিক সমকালে লিখদেন। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির ৩ খণ্ডে ‘বাঙালা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থেও সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।
মুক্তিযু’দ্ধে ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক অজয় রায়ের বাংলাদেশের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু’দ্ধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্থানি বাহিনী নৃশং’স গণহ’ত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযু’দ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন। সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসবে নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরসূরী হিসবে একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মুক্তিযু’দ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
ছবি: তরুণ বয়সে ড. অজয় রায়
মানবাধিকার
অধ্যাপক অজয় বাংলাদেশের সংখ্যা-লঘুদের উপর নির্যা’তন এবং নিপী’ড়ন রো’ধে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের অ’ব্যবহিত পর বাংলাদেশে সংখ্যা-লঘু সম্প্র’দায়ের উপর নির্যা’তন এবং নিপী’ড়ন বৃদ্ধি পেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদা’য়িকতা প্রতিরো’ধ কমিটি’র ব্যানারে সাম্প্রদা’য়িকতা বিরো’ধী আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি মনিটরিং সেল গঠন করে বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিলে সংখ্যা-লঘুদের সহায়তা করেন। ইন্টারনেটে সংখ্যা-লঘুদের দু’র্দশার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ শিরোনামে সিরিজ শুরু করেছিলেন।
ভোলার অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে বিভিন্ন নির্যা’তিত নারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং দা’ঙ্গায় যারা গৃহ হারিয়েছিলেন, তাদের গৃহ পুনর্নিমাণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের সাথে মিলে অধ্যাপক অজয় রায় ‘গণ তদন্ত কমিশন’ তৈরি করেন, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০০২ সালে। দেশের পাহাড়ি জনগণ এবং আদিবাসীদের অধিকার এবং স্বায়ত্ত্বশাসনও তিনি জো’রালোভাবে সমর্থন করেন। তিনি মনে করতেন, পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি অধিবাসীদেরকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়া দরকার।
বিজ্ঞানমনস্কতা ও মুক্তবুদ্ধির প্রসার
অধ্যাপক অজয় রায় বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। তিনি বিজ্ঞানকে তরুণ প্রজন্মে বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেবার প্রয়াসে তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভার আয়োজন করেন। তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করছেন।
এ ছাড়াও তিনি মুক্তান্বেষা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসবে কাজ করেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। তিনি বাংলাদেশের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনারে পঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তমনা এবং মুক্তচিন্তক লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ স্বতন্ত্র ভাবনা তার পরিচালনায় প্রকাশিত হয়েছে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
একুশে পদক (২০১২), এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলোশিপ (২০০৯), বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (২০০৮), ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অফ ম্যাথেমাটিকাল ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স কর্তৃক সম্মাননা [বিজ্ঞানে তার সামগ্রিক অবদানের নিরিখে প্রদত্ত (২০০৮)] ইত্যাদি।
রচনাকর্ম:
বিজ্ঞান ও দর্শন, জড়ের সন্ধানে (১৯৯৩-৯৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আদি বাঙালি : নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭) [ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত পুস্তক], স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা), চারদিক, ২০০৮, লীলা নাগ : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি (সম্পাদনা), সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩।, পদার্থবিদ্যা (সহ-অনুবাদক, মূল: রেসনিক, হ্যালিডে) (অনুবাদ এবং সম্পাদনা), বাংলা একাডেমি বিজ্ঞানকোষ (প্রথম হতে পঞ্চম খণ্ড) (সম্পাদনা), মুক্তান্বেষা ষাণ্মাসিক ম্যাগাজিন (সম্পাদনা), মুক্তমনা ও শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ইত্যাদি।
সূত্র: উইকিপিডিয়া