আর্সেনালের নতুন কোচ মিকেল আরতেতা, আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন?

0

স্পোর্টস ডেস্ক:

আর্সেনালের কোচ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন দলটার সাবেক খেলোয়াড় স্প্যানিশ মিডফিল্ডার মিকেল আরতেতা। ম্যানেজার হিসেবে তার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করতে পারে আর্সেনালের সমর্থকেরা?

বছর তিনেক আগের কথা। খেলোয়াড় হিসেবে মিকেল আরতেতা তখন আর্সেনালে তার শেষ মৌসুম কাটাচ্ছেন।

আর্সেনালের ওয়েবসাইটে তাকে নিয়ে একটা ভিডিও বানানো হলো। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মিকেল আরতেতা এফসি’ বলে যদি কোনো ক্লাব হয়, সে ক্লাবটার দর্শন কী হবে?

মুহূর্তের মধ্যে খেলোয়াড়ি খোলস থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণের জন্য পুরোদস্তুর কোচ বনে গেলেন যেন আরতেতা, আমি চাইব, প্রত্যেক খেলোয়াড় যেন মাঠের মধ্যে তাদের ১২০ শতাংশ দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই। কোনো খেলোয়াড় যদি এই দায়বদ্ধতাটুকু আমাকে না দেখাতে পারে, তার আর আমার হয়ে খেলার দরকার নেই। কাজের সময় কাজ, অবসরের সময়… অবসরের সময় আমিই সবার সঙ্গে গিয়ে মজা করব, পার্টি করব। কিন্তু কাজের সময় কাজটা ঠিকই করতে হবে।

তার দলের স্টাইলের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন, গোটা খেলাটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতি-পক্ষ নয়, আমরাই চাইব খেলার গতিপথ ঠিক করে দিতে। যারা খেলা দেখতে আসে তারা শুধু জেতার জন্যই আসে না। তারা খেলা দেখে আনন্দিত হতেও আসে। সে জিনিসটাও মাথায় রাখতে হবে আমাদের।

তখন আরতেতার বয়স কতই-বা হবে? ৩৩। এই বয়সে একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন ম্যানেজারসুলভ কথা কত জন প্রত্যাশা করে?

কিন্তু আরতেতা আর দশটা খেলোয়াড়ের মতো ছিলেন না। খেলাটাকে তিনি যতটা খেলোয়াড়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন, তার থেকে বেশি দেখতেন একটা কোচের দৃষ্টি থেকে। এ কারণেই কি না, অনুশীলনের মাঠে সতীর্থদের চেয়ে তার ‘সখ্য’ বেশি দেখা যেত ক্লাবের ভিডিও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে, আর্সেনালের তৎকালীন কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের সহকারী কোচদের সঙ্গে। যারা নিজেদের ও প্রতি-পক্ষের প্রত্যেকটা মুহূর্তের হিসাব রাখতেন। পরিসংখ্যান রাখতেন। এমনও হয়েছে আইপ্যাডে ফুটবল অ্যাপের মধ্যে নিজের পরিকল্পনা বানিয়ে নিয়ে কোচদের দেখাতেন।

তখন থেকেই ক্লাবের সবাই মোটামুটি জেনে গিয়েছিলেন, আর্সেন ওয়েঙ্গার শুধু একজন খেলোয়াড়ই বানাচ্ছেন না, ভবিষ্যৎ ম্যানেজারও বানিয়ে যাচ্ছেন একজনকে। পার মার্টেস্যাকার, অ্যারন র‍্যামসে, থিও ওয়ালকট, জ্যাক উইলশেয়ার, অলিভিয়ের জিরুদের মতো আর্সেনাল-সতীর্থরা আড়ালে-আবডালে তার ডাকনাম দিয়েছিলেন— ‘গ্যাফার’, যার অর্থ দলের কোচ। আরতেতার সঙ্গে ওয়েঙ্গারের ঘনিষ্ঠতাও অন্যান্য খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি ছিল। যে কারণে তার আরেকটা ডাকনামও ছিল, ‘ম্যানেজার্স পেট’ অর্থাৎ ‘কোচের পোষ্য।’

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। আরতেতা নিজেও নিজের ম্যানেজার-সত্তাকে সতীর্থদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন না। যে কোনো ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার পর আর্সেন ওয়েঙ্গার সাধারণত অত বেশি কথা বলতে পছন্দ করতেন না। তখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে তাদের উজ্জীবিত করা, তাদের নিজ নিজ ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটা আরতেতাই করতেন, যোগ্য অধিনায়কের মতো। ওয়েঙ্গার নিজে কেন এই কাজটা করছেন না, সে নিয়ে আরতেতার একটু বির’ক্তিও ছিল বৈকি!

ওয়েঙ্গার যখন আর্সেনালের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন, স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছিল, গুরুর ফেলে যাওয়া জায়গায় বসবেন আরতেতা। কিন্তু কোচের মতো মেধা-মনন থাকলেও প্রধান কোচ হিসেবে অতীত কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আরতেতার ওপর ভরসা রাখতে পারেনি ম্যানেজমেন্ট। আর একজন অনভিজ্ঞ ম্যানেজারকে খরচ করতে দেওয়ার জন্য টাকাও দেওয়া যায় না।

আর্সেনালের কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, তাদের শিরোপা জেতার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী দল আছে, দল নতুন করে গড়ার কোনো দরকার নেই। দরকার শুধু শিরোপা জেতার। ফলে সেবার শেষ মুহূর্তে পিছু হটে আর্সেনাল। নিয়োগ দেয় আরতেতার স্বদেশি উনাই এমেরিকে। ওদিকে আরতেতা থেকে যান ম্যানচেস্টার সিটিতে, পেপ গার্দিওলার সহকারী হিসেবে।

‘অনভিজ্ঞ হওয়ার খোঁটা যখন দেওয়াই হলো, বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচের কাছ থেকেই নেব কোচ হওয়ার পাঠ’— আরতেতার মনে এমন কোনো চিন্তা উঁকি দিয়েছিল কি না, তখন জানা যায়নি যদিও।

তবে গার্দিওলা কিন্তু ঠিকই চিনেছিলেন আরতেতা নামের রত্নকে। খেলোয়াড় পেপ গার্দিওলা যখন বার্সা ছাড়লেন, তখন তার বিকল্প মিডফিল্ডার হিসেবে ‘লা মাসিয়া’ থেকে এই আরতেতাকেই তুলে এনেছিল বার্সেলোনা। তখন থেকেই নিজের চেয়ে ১১ বছর বয়সী এই ‘ছোট ভাই’টার প্রতি অন্যরকম টান কাজ করত গার্দিওলার।

২০১২ সালে, চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে গার্দিওলার বার্সেলোনা যখন চেলসির সঙ্গে খেলতে গেল, তখন চেলসির শহরের আরেক ক্লাব এই আর্সেনালের খেলোয়াড় আরতেতাকে ফোন করে চেলসির শক্তিমত্তা সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলেন গার্দিওলা। তাতে লাভ হয়নি অবশ্য, বার্সাকে হারিয়েই সেবার ফাইনালে ওঠে চেলসি। তবে আরতেতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ মুগ্ধ করেছিল গার্দিওলাকে।

২০১৫ সালে পেপ গার্দিওলার বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে ওই চ্যাম্পিয়নস লিগেই দেখা হয় আর্সেনালের। আর্সেনালকে হেসে-খেলে ৫-১ গোলে হারানোর পর আরতেতার সঙ্গে আরেক দফা কথা বলেন বায়ার্ন কোচ। মুগ্ধ গার্দিওলা আরতেতাকে জানিয়ে দেন, কখনো ইংলিশ কোনো ক্লাবের দায়িত্ব নিলে আরতেতাকে সহকারী হিসেবে চান তিনি।

আরতেতা তখনো বোঝেননি, গার্দিওলা তখন ম্যানচেস্টার সিটির নতুন কোচ হওয়ার জন্য ইতিমধ্যে আলোচনা করা শুরু করে দিয়েছেন। কিছুদিন পর গার্দিওলা বায়ার্নকে কীভাবে খেলান, সেটা দেখার জন্য জার্মানিতে গিয়েছিলেন আরতেতা। দু’জনই ক্রমশ বুঝলেন, তাদের চিন্তাধারায় রয়েছে যথেষ্ট মিল।

ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়েরাও আরতেতাকে গার্দিওলার মতো নিজেদের আরেক কোচ হিসেবেই মানতেন। বছর তিনেক আগে, আরতেতার সাবেক ক্লাব আর্সেনালের বি’পক্ষে ম্যানচেস্টার সিটি যখন খেলতে নামল, গার্দিওলা এক রকম ঘোষণা দিয়েই শুধু সেই ম্যাচের জন্য দলের প্রধান কোচ বানিয়ে দিয়েছিলেন আরতেতাকে।

তখন গার্দিওলা মাত্রই সিটির কোচ হিসেবে এসেছেন, ওদিকে আর্সেনালের নাড়ির খবর ভালো জানতেন আরতেতা। সে ম্যাচে নিজের মস্তিষ্কের জোর দেখিয়ে আর্সেনালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেন ম্যানসিটি। সবাই আরও নিঃসন্দেহ হয়, শুধুমাত্র সহকারী রাখার জন্য রাখেননি গার্দিওলা। যোগ্যতা দেখিয়েই আরতেতা পেয়েছেন এই পদ।

এবার সেই যোগ্যতা আর্সেনালকে দেখানোর পালা। নিজের বাড়িঘরের দেয়ালে ফরমেশন আঁকা আঁকি করে ২৪ ঘণ্টা ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকা এই ম্যানেজার আর্সেনালের জন্য কতটুকু যোগ্য, আস্তে আস্তে দেখা যাবে এবার।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!