অর্থনীতি ডেস্ক:
প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ভারত থেকে গত বছর ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে টেলিনর। পাকিস্থান ও মিয়ানমারেও ভালো অবস্থায় নেই প্রতিষ্ঠানটি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি গ্রাহক রয়েছে টেলিনরের। আয়ের বিবেচনাতেও টেলিনরের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন।
তবে নিরীক্ষা আ’পত্তির অর্থ আদায় নিয়ে সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বিরো’ধ তু’ঙ্গে উঠেছে অপারেটরটির। চলমান বিরো’ধ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে গ্রামীণফোনের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক টেলিনর। এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশে টেলিনর ব্যবসা অ’ব্যাহত রাখবে কি না, তা নিয়েও চলছে আলোচনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিক আয়ের প্রবৃদ্ধি ও মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠান হলেও নিরীক্ষা আ’পত্তির ১২ হাজার কোটি টাকা দিতে হলে বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়বে গ্রামীণফোন। এজন্য বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের বাজার ছাড়ার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে টেলিনরের। ভারতীয় অন্যতম শীর্ষ টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা আ’পত্তির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বিষয়টি নি’ষ্পত্তিতে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে টেলিনর। সালিশের উদ্যোগ নিতে সিঙ্গাপুরের একটি ল ফার্মের মাধ্যমে এ নোটিশ পাঠানো হয়। আরবিট্রেশন না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথাও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
টেলিনরের এ নোটিশ প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, মূলত সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় রাষ্ট্রপতির পক্ষে। সেজন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর এ নোটিশ দেয়া হয়ে থাকতে পারে। এতে আইনি কোনো ব্য’ত্যয় হয়নি। তবে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়ামের। টেলিনর সেটির অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। নোটিশ পাঠালে গ্রামীণফোনের পাঠানোর কথা। টেলিনর এখানে পক্ষ নয়। এছাড়া আদালতের আদেশ হওয়ার পরও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গ্রামীণফোনের দাবি অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালের ১০ অক্টোবর ৩টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়াম। প্রতিষ্ঠান ৩টি হলো- টেলিনর, গ্রামীণ টেলিকম ও গণফোন। একই বছরের ২৮ নভেম্বর লাইসেন্স পায় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ দেশের প্রথম অপারেটর হিসেবে জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন) প্রযুক্তির সেলফোন সেবা চালু করে গ্রামীণফোন। কার্যক্রমে আসার ১ যুগ পর ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি।
লাইসেন্স পাওয়ার সময় গ্রামীণফোনে টেলিনরের শেয়ার ছিল ৫১ শতাংশ। বাকি শেয়ারের মধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের ছিল ৪৪.৫ শতাংশ ও গণফোনের ৪.৫ শতাংশ। তবে ৬ বছর পর গ্রামীণফোনের ১৪ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল টেলিনর। কিন্তু তা না করে পরবর্তী সময়ে উল্টো নিজেদের শেয়ার বাড়ায় তারা। বর্তমানে গ্রামীণফোনে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার রয়েছে ৫৫.৮ শতাংশ। বাকি ৩৪.২ শতাংশ গ্রামীণ টেলিকম ও ১০ শতাংশ সাধারণ শেয়ার।
গত ২ দশক ধরে দেশে সেলফোন সেবা দিচ্ছে গ্রামীণফোন। এ সময়ের মধ্যে দেশসেরা অপারেটর হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারা। একই সঙ্গে নানা ধরনের অ’নিয়মের সঙ্গেও জড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অ’বৈধ ভিওআইপি, কর ফাঁ’কি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অ’মান্যসহ আরো নানা ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে জরি’মানাও দিতে হয়েছে তাদের।
২০১১ সালে পরিচালিত এক নিরীক্ষার ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যায় গ্রামীণফোন। ২০১৫ সালে আবারো গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ নিরীক্ষা শেষে চলতি বছরের এপ্রিলে অর্থ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠি দেয়া হয়।
বিটিআরসির দাবি অনুযায়ী, নিরীক্ষা আ’পত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের। ২ সপ্তাহ সময় দিয়ে পাওনা পরিশোধে গত এপ্রিলে গ্রামীণফোনকে নোটিশ দেয় বিটিআরসি। নিরীক্ষার ভিত্তিতে পাওনা অর্থ দাবি করা হয় অন্য অপারেটর রবির কাছেও। অর্থ পরিশোধে অপারেটর দুটিকে ২ সপ্তাহ সময় দেয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে অপারেটর দু’টির অ’নাপত্তি সনদ (এনওসি) প্রদান বন্ধ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। লাইসেন্স কেন বাতিল হবে না তা জানতে চেয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি তাদের চিঠি দেয়। তবে এর আগেই ঢাকার দেওয়ানি আদালতে গত ২৬ আগস্ট মামলা দায়ের করে গ্রামীণফোন।
এমন পরিস্থিতিতে বিরো’ধ মীমাংসায় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, বিটিআরসি ও অপারেটর দু’টির কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠকে রবির কাছে মূল দাবি ৫০৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৫ কোটি টাকা ও গ্রামীণফোনের কাছে মূল দাবি ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা দিতে বলা হয়। ৭ দিনের মধ্যে রবি ২৫ কোটি ও গ্রামীণফোনের ১০০ কোটি টাকা দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও অপারেটর দু’টি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। সং’কটের সুরাহা না হওয়ায় প্রশাসক নিয়োগে বিটিআরসির আবেদনে অনুমোদন দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
গত নভেম্বরে নিরীক্ষা দাবির পাওনা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধে গ্রামীণফোনকে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, ৩ মাসের মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের স্থ’গিতাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। আপিল বিভাগের এ আদেশের বিরু’দ্ধে ১ মাসের মধ্যে রিভিউ করতে পারবে গ্রামীণফোন। এরই মধ্যে রিভিউ আবেদন জমাও দিয়েছে অপারেটরটি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, নিরীক্ষা দাবির এ অর্থ কোনো ব্যক্তির নয়, দেশের। এটি তাদের দিতে হবে। আদালত থেকেও এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নে’তিবাচক প্রভাব এতে পড়বে না। বরং এখন এ খাতের বিদেশী অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আবেদন রয়েছে। আগামীতে ফাইভ-জি চালু হলে নতুন অপারেটরের লাইসেন্স নিতেও আগ্রহী দেখিয়েছে তারা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের অনুমোদিত মূলধন ৪ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৩৫০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কোম্পানির বাজার মূলধন ৩৯ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। রিজার্ভে রয়েছে ২ হাজার ১২৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
সর্বশেষ অ-নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি হিসাব বছরের প্রথম ৩ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) গ্রামীণফোনের কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ২ হাজার ৬৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৪৮১ কোটি ২৪ লাখ টাকা (পুনর্মূল্যায়িত)।
হিসাব বছরের ৩য় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৭২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল ৮৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা (পুনর্মূল্যায়িত)। ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছিল ৩ হাজার ৫১৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল ২ হাজার ৭৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, ভারতের টেলিযোগাযোগ খাতে টেলিনরের যাত্রা ২০০৮ সালে। তবে বাজার প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি টিকতে না পেরে পেরে ভারতে ব্যবসা কার্যক্রম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সালজুড়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যক্রম একীভূতকরণ ও ব্যবসা বিক্রির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় তারা। বিপুল পরিমাণ ঋ’ণের কারণে টেলিনর ইন্ডিয়ার পুরো দায়-দায়িত্বও বুঝে নিতে আগ্রহী ছিল না ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
পরবর্তী সময়ে ভারতী এয়ারটেলের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের মে মাসে টেলিনরের ভারতীয় কার্যক্রম অধিগ্রহণে ভারতী এয়ারটেলকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশন্স (ডিওটি)।
এদিকে, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাংলাদেশে নিজেদের কার্যক্রম একীভূত করেছে ভারতী এয়ারটেল। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ২০১০ সালে। সে সময় ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠা করা হয় এয়ারটেল বাংলাদেশ। তবে কার্যক্রম শুরুর পর গত কয়েক বছরে প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সালে রবি আজিয়াটার সঙ্গে একীভূত হয় এয়ারটেল বাংলাদেশ।
চলতি বছরের মে মাসে এশিয়াতে আজিয়াটার সঙ্গে নিজেদের ব্যবসা একীভূত করার উদ্যোগ নেয় টেলিনর। দেশের দুই শীর্ষ সেলফোন অপারেটরের মূল মালিকানায় থাকা দুই টেলিযোগাযোগ গ্রুপের এ একীভূতকরণ কার্যক্রম পরবর্তী সময়ে স্থ’গিত হয়।
625