আমার মাকে ‘মা’ ডাকতেন শেখ সাহেব: রেজিয়া ভাসানী

0

সময় এখন ডেস্ক:

বাবাকে “হুজুর” বললেও আমার মাকে “মা” বলে ডাকতেন শেখ সাহেব। শেখ সাহেবের অন্তরের ভালোবাসা পেয়েছি আমরা। আমাদের দেখতেন ও ভালোবাসতেন ছোট ভাই-বোনের মতো। অসংখ্যবার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শেখ সাহেব।

বাড়িতে এলেই তিনি আমাদের সবাইকে কাছে ডেকে নিয়ে ১০টি করে টাকা দিতেন। বাবাও উনাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। এ দাবিতেই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরও বাবা উনাকে ‘মজিবর’ নামেই ডাকতেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আলেমা ভাসানীর বড় মেয়ে রেজিয়া ভাসানী (৯২)।

বিয়ের সুবাদে ১৯৪৯ সাল থেকে পাবনা সদরের গোপালপুর লাহেড়ীপাড়ায় স্বামী প্রয়াত অ্যাডভোকেট আব্দুস সবুরের বাড়িতে বসবাস করে আসছেন রেজিয়া ভাসানী। তিনি ৫ মেয়ে ও ২ ছেলে সন্তানের জননী। ২০০০ সালে ক্যান্সারে মা’রা যান তার মেজমেয়ে মনি। পরের বছর ২০০১ সালের ২৫ জুন স্বামী, আর ওই বছরের ৪ অক্টোবর মা হারা হন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে হৃদরোগে প্রাণ হারান ছেলে মতি।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আলেমা ভাসানীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বর্তমানে দুই মেয়ে রেজিয়া ভাসানী ও মাহমুদা খানম ভাসানী (৭৪) জীবিত আছেন।

রেজিয়া ভাসানী বলেন, শেখ সাহেব কলেজের ছাত্র থাকাবস্থাতেই জেলে যান। সেখানেই তার পরিচয় বাবার সঙ্গে। এ পরিচয়েই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ সাহেবের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল উনার। অসংখ্যবার একসঙ্গে জেলে গেছেন বাবা আর শেখ সাহেব।

স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন শেখ সাহেব। এরপর বাবাকে (মওলানা ভাসানী) ইন্ডিয়া থেকে দেশে আনার দাবি তোলেন ভাসানীর অনুসারীরা। কিছুদিন পর দেশে ফেরেন বাবা ও মা। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার কারণে তারা (টাঙ্গাইলের) সন্তোষের একটি গোয়ালঘরে ওঠেন।

বাবা সন্তোষ থেকেই শেখ সাহেবকে গ্রামবাসীর জন্য সাহায্য পাঠাতে বলতেন, আর শেখ সাহেবও তা পাঠিয়ে দিতেন। বাবা নিজ হাতে সেসব সাহায্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে থেকে শেখ সাহেব নিজেও যু’দ্ধবিধ্ব’স্ত এ জেলার অসংখ্য গ্রামবাসীর মাঝে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।

স্মৃতি আঁকড়ে কথাগুলো বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ভাসানীর বড় মেয়ে। তিনি বলেন, শেখ সাহেব আমাদের ভাই-বোনের মতো দেখলেও তাঁর দলের লোকজন আমাদের খবর রাখেন না।

২০০১ সালে আলেমা ভাসানী খুব অসুস্থ থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও ব্যর্থ হওয়ার কথা জানিয়ে আক্ষেপ করেন রেজিয়া ভাসানী। তিনি বলেন, ওই বছরের ৪ অক্টোবর মৃ’ত্যুবরণ করেন আমার মা আলেমা ভাসানী।

মওলানা ভাসানীর ছেলে আবু নাসের খান ভাসানীর বড় মেয়ে সালেহা খান ভাসানী শিলু (৫১) বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন।

তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে আমার বয়স ছিল ৫ থেকে ৬ বছর। সে সময় দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বাসায় এসেছেন। আমার দাদাকে শ্রদ্ধা করতেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। দাদাকে ‘হুজুর’ বললেও দাদিকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। এ কারণে তখন আমি ভাবতাম তিনি আমার চাচা। তিনি আমাদেরও খুব ভালোবাসতেন।

আমার দাদার মৃ’ত্যুর সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি দাদুর মাজারে এলেও দাদিকে দেখতে বাড়িতে আসেননি।

ভাসানীর বাসভবনের পাকা দালান প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর নাতনি শিলু বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান থাকাকালে একদিন দাদার মাজার জিয়ারত করতে এবং দাদিকে দেখতে তাদের বাড়িতে আসেন, সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী রওশন এরশাদও। ওইদিন রওশন বাথরুমে যাওয়ার কথা বলেন। এ সময় দাদি আলেমা ভাসানী বলেন, কলাপাতায় ঘেরা আমার বাথরুম, তুমি যাবা কীভাবে?

এ কথা শুনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমার দাদিকে বলেন, মা, আমি আপনাকে একটি বাড়ি করে দেব। সেই কথামতো সেনাবাহিনীর সদস্যদের একদিনের বেতনের টাকা দিয়ে এই বাড়িটি করে দিয়েছিলেন তিনি।

পরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। গড়ে তোলেন জনদল। ওই দলের সদস্য হন আমার বাবা আবু নাসের খান ভাসানী। এরই বদৌলতে ১৯৮৪ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গঠিত সরকারের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন আমার বাবা— যোগ করেন মওলানা ভাসানীর নাতনি সালেহা খান ভাসানী শিলু।

বঙ্গবন্ধুর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা কোনো সরকারই ভাসানীকে মূল্যায়ন করেনি অভিযোগ করে এজন্য আক্ষেপও করেন তিনি।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর হ’ত্যাকারীদের মাথায় হাত রেখে তাদেরকে জাতির সূর্যসন্তান বলে দোয়া করা, হ’ত্যাকারীদেরকে মদদদাতা ও ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের সাথে ভাসানীর আপোস, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যু’দ্ধাপরাধ ঘটানো জামায়াতে ইসলামকে পুনর্বাসন ও সংগঠিত করায় সহযোগিতা করা,

যু’দ্ধাপরাধীদের জেল থেকে বের করার আন্দোলন করাসহ নানান বিত’র্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় মাওলানা ভাসানীর প্রতি আওয়ামী লীগ স্বভাবতই আগ্রহ হারিয়েছে বহু বছর আগেই।

শেয়ার করুন !
  • 208
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!