প্রতিরক্ষা ডেস্ক:
সাগরে জলদস্যুতার অপরাধে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে সংসদে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২১’ পাস হয়েছে।
রোববার (২৮ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ১৯৭৪ সালের ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন’ আইন সংশোধন করে নতুন এই আইনটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিল পাসের আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই বাছাই কমিটিতে পাঠান এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করেন।
বিলে বলা হয়েছে, জলদস্যুতা, সশস্ত্র চুরি, সমুদ্র সন্ত্রাস করতে গিয়ে কেউ খুন করলে মৃত্যুদণ্ড হবে। আর জলদস্যুতা বা সমুদ্র সন্ত্রাসের শাস্তি হবে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া দস্যুতা করে যা লুট করবে, তার দায়ে জরিমানা হবে।
কোনো ব্যক্তি জলদস্যুতা বা সমুদ্র সন্ত্রাসের চেষ্টা বা সহায়তা করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় জলসীমায় কোনো বিদেশি জাহাজে অপরাধ সংগঠিত হলে অপরাধী গ্রেপ্তার ও তদন্ত পরিচালনায় এ আইন প্রযোজ্য হবে।
উল্লেখ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের মেরিটাইম অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ এবং সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম অ্যাক্ট ১৯৭৪’ প্রণয়ন করা হয়।
পরে ১৯৮২ সালে ‘ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি’ শীর্ষক কনভেনশন জাতিসংঘ গ্রহণ করলে একই বছর ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তাতে স্বাক্ষর করে।
আগের আইনে সামুদ্রিক দূষণের জন্য সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। বিলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বনিম্ন ২ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিলে ওশান গভর্নেন্স, ব্লু ইকোনোমি, মেরিটাইম কোঅপারেশন সংক্রান্ত নির্দেশনামূলক বিধি-বিধান সংযোজন করা হয়েছে। বিশেষ করে মেরিন সায়েন্টিফিক রিসার্চের পদ্ধতি ও অনুশাসন সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সংশোধিত আইনে ৩৬টি ধারা রয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রণীত বেইজলাইন ইউএনক্লস-১৯৮২ এর আলোকে পুনঃনির্ধারণ করা হয় যা গত ১০ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে “বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলে বেইজলাইন পুনঃনির্ধারণ” সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন আকারে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল।
সংশোধিত আইনে ইউএনক্লস-১৯৮২ এর আলোকে পুনঃনির্ধারিত বেইজলাইন বিবৃত হয়েছে। এছাড়াও, ইন্টারনাল ওয়াটারস, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস, কন্টিগিউয়াস জোন, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন, কন্টিনেন্টাল শেলফ, এরিয়া, হাই সি-সহ মেরিটাইম অঞ্চলসমূহে সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের অধিকার বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে।
১৯৭৪ সালের আইনটি যুগোপযোগী করার নিমিত্ত আধুনিক মেরিটাইম সংক্রান্ত বিষয়াবলি ও প্রযুক্তি যেমন রিমোটলি অপারেটেড আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যাল (আরওভি), অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যাল (এইউভি), আনম্যানড আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যাল (ইউইউভি) ইত্যাদির সংজ্ঞা সংশোধিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিদেশি জাহাজ বা সাবমেরিনের বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের ক্ষেত্রে ফৌজদারি এখতিয়ার ও দেওয়ানি এখতিয়ার উভ্য়ই সংশোধিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সমুদ্রে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তা ভিন্নমাত্রিক হওয়ায় পৃথক মেরিটাইম ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার বিধান বিলে রাখা হয়েছে। অপরাধ বা দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ভিডিও, ছবি, ইলেকট্রনিক রেকর্ডকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করারও সুযোগ থাকছে।
পাশাপাশি, সংশোধিত আইনে জলদস্যুতার কাজে ব্যবহৃত জাহাজে পরিদর্শন, আরোহণ, জব্দ, সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং গ্রেপ্তার সংক্রান্ত বিধিবিধান সংযুক্ত করা হয়েছে।
ইন্টারনাল ওয়াটারস এবং টেরিটোরিয়াল সি-তে পারমাণবিক অথবা বিষাক্ত দ্রব্য ফেলার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
কন্টিনেন্টাল শেলফের (মহীসোপান) সংজ্ঞা ও সীমা ইউএনক্লস-১৯৮২ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মামলার রায় অনুযায়ী বিদ্যমান আইনের সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই অঞ্চলের সেফটি জোন নির্ধারণ, সাবমেরিন কেবল ও পাইপলাইন স্থাপন সংক্রান্ত বিধানও সংযোজিত হয়েছে।
বিলে ‘ইকোনোমিক জোনের’ পরিবর্তে ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সকল প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আগের আইনের ‘কন্টিগিউয়াস জোনের’ সংজ্ঞা ও সীমা ইউএনক্লস-১৯৮২ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধন করা হয়েছে। কন্টিগিউয়াস জোনের ব্যাপ্তি ১৮ থেকে ২৪ মাইল করা হয়েছে।
বিলটি পাস হওয়ায় অভ্যন্তরীণ জলসীমা ও রাষ্ট্রীয় জলসীমা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে সমুদ্র সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।
বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের উপর বাংলাদেশের মানুষের সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ, টেকসইভাবে অনুসন্ধান ও আহরণ, সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল অর্জন এবং সামগ্রিকভাবে দেশ ও দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২১’ বিলটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।