সময় এখন ডেস্ক:
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দু’সপ্তাহের তীব্র ল’ড়াই শেষে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর আত্ম’সমর্পণের ২৪ ঘণ্টাও পার হয়নি। তখনও মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকা পুরোপুরি শত্রু-মুক্ত হয়নি, বিচ্ছি’ন্ন কিছু পকেটের মতো সেগুলো ছিল পাকিস্থানিদের দখলে।
এরকমই একটা জায়গা ছিল খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন– ধানমন্ডির বাড়ি; যেখানে তার পরিবারের সদস্যদের কার্যত জি’ম্মি করে রেখেছিল ডজনখানেক সশ’স্ত্র পাকিস্থানি সৈন্য।
শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করার কঠিন দায়িত্ব নিয়ে সে দিন সকালে ধানমন্ডিতে গিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক তরুণ কর্মকর্তা, মাত্র ২৯ বছর বয়সী সেই মেজরের (পরে কর্নেল) নাম ছিল অশোক কুমার তারা। বাংলাদেশের মুক্তিযু’দ্ধের সময় ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে ‘ব্যাটল অব গঙ্গাসাগর’ বা গঙ্গাসাগর যু’দ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার জন্য তিনি পরবর্তীতে ‘বীর চক্র’ খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন।
সেদিন তার সঙ্গে ছিলেন মাত্র ২-৩ জন জওয়ান। তবে তাদেরকেও গাড়িতে রেখে তিনি একাই নির’স্ত্র অবস্থায় এগিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্থানি সেনাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আত্ম’সমর্পণ করানোর জন্য। সেই ‘মনস্তাত্ত্বিক যু’দ্ধে’ জিতে মেজর অশোক কুমার তারা কীভাবে ওই ১০-১২ জন সৈন্যকে অ’স্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য করিয়েছিলেন, সে এক অভূতপূর্ব কাহিনী।
সম্পূর্ণ অক্ষ’ত শরীরে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলেন গৃহবন্দি থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, কোলের শিশুপুত্রসহ শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা এবং বঙ্গবন্ধুর ছেলেরা।
এত বছর পর সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) অশোক কুমার তারা কাছে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন, যা তার মনের মণিকোঠায় আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে তিনি বলছিলেন, ‘পাকিস্থানি সেনাদের বিদায়ের পর দরজা খুলতেই এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর পত্নী। আমার কাঁধে-মাথায় হাত রেখে তিনি ঠিক মায়ের মতো অকুণ্ঠ আশীর্বাদ করলেন।’
‘এদিকে ঠিক তখনই কেউ একটা এসে খবর দিলো, ধানমন্ডির ওই বাড়ির ছাদে তখনও পত পত করে উড়ছে পাকিস্থানি পতাকা। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম ছাদে। পোলটা বেয়ে উঠে নামিয়ে আনলাম পতাকাটা, ছুঁড়ে দিলাম নিচের দিকে। মাটিতে পতাকা পড়তেই এগিয়ে এলেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা। কী প্রবল ঘৃ’ণাভরে সেই পতাকাটা তিনি নিজের পায়ে দলতে থাকলেন, আমি তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না! বাংলাদেশ নামক স্বাধীন, সার্বভৌম ভূখণ্ডটিতে পাকিস্থানিদের অত্যা’চার-অ’মানবিকতা ও গণহ’ত্যার বিরুদ্ধে কী পরিমাণ ক্ষো’ভ, ঘৃ’ণা ও বিদ্বে’ষ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে আমি সে দিনই তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম বেগম ফজিলাতুন্নেসার চোখেমুখে!’, কথাগুলো খুব ধীরে ধীরে ও থেমে থেমে বলতে থাকেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তা।
যে দেশ ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম, সেই পাকিস্থানের জাতীয় পতাকাই বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্নে পায়ে দলছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব– মুক্তিযু’দ্ধের পটভূমিতে এ এক অসামান্য দৃশ্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে খুব কম লোকই হয়তো এই আইকনিক ঘটনাটির কথা জানেন, নতুন করে যেটির স্মৃতি উদ্ধার করেছেন সাংবাদিক রঞ্জন বসু।
মুক্তিযু’দ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মেজর অশোক কুমার তারাকে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মানে ভূষিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এমনকি, গত বছর শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সম্মান ও স্বীকৃতি জানানো হয়েছে একাত্তরের এই বীর নায়ককে।
অশোক কুমার তারা জানান, আজও তার চোখে ভাসে সেই দৃশ্য– টানা কয়েক মাসের ব’ন্দিদশা থেকে সদ্য মুক্তি পেয়েই প্রবল ঘৃ’ণা আর বিদ্বে’ষে পাকিস্থানের চাঁদ-তারাখচিত জাতীয় পতাকাকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব!
19K