আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গত ২৮ মে সিন্থিয়া ডি রিচি টুইটে অভিযোগ করেন, বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে যেসব মহিলার সম্পর্ক ছিল, নিজের রক্ষীদের সেইসব মহিলাদের ধ’র্ষণ করার নির্দেশ দিতেন বেনজির। সিন্থিয়া এক দশকের বেশি সময় পাকিস্থানে বাস করছেন। এরপর থেকে বিষয়টি জটিল আকার নিতে শুরু করে এবং পাকিস্থান পিপলস পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টিতে জড়াতে থাকেন।
শনিবার সিন্থিয়া রিচি অভিযোগ করেন, প্রাক্তন মন্ত্রী রেহমান মালিক তাকে ধ’র্ষণ করেছেন এবং প্রাক্তন পাকি প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ও আরেক মন্ত্রী তার শ্লী’লতাহা’নি করেছেন। মালিক ও গিলানি উভয়েই অভিযোগ অ’স্বীকার করেছেন।
সিন্ধ প্রদেশের শাসক দল পিপিপি, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক পরাজয়ের পর এ ঘটনায় ফের ধাক্কা খেয়েছে এবং দাবি করেছে, ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে দিয়ে সিন্থিয়ার বিরু’দ্ধে তদন্ত করা হোক এবং পাকিস্থানে তার বসবাসের শর্ত খতিয়ে দেখা হোক।
পাকিস্থান সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটে পিপিপি’র প্রতিনিধি শেরি রহমান টুইটারে পোস্ট করে বলেছেন, আমি সাধারণত এ ধরনের নোং’রা ঘাঁটি না, কিন্তু এসব মানহা’নিকর, জ’ঘন্য অপ’বাদ সম্পূর্ণ মিথ্যানির্ভর। মহিলাদের অধিকার নিয়ে সদাসচেতন একজন শহিদ প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের নোং’রামি এই ব্লগ লেখকের পক্ষেই অব’মাননাকর, তার বেশি কিছু নয়।
করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সং’ক্রমণ নিয়ে পাকিস্থান ভুগলেও বেশ কিছু দিন ধরে পাকিস্থানিরা সিন্থিয়া রিচিকে নিয়ে মেতে উঠেছেন। পিপিপি’র বহু বিরো’ধী এই মুহূর্ত উপভোগ করছেন বটে, কিন্তু সমসংখ্যক মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, কে এই সিন্থিয়া রিচি?
কে এই সিন্থিয়া রিচি?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পক্ষ থেকে তাকে একগুচ্ছ প্রশ্নের তালিকা পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি জানিয়েছেন এ সপ্তাহে আসন্ন লাইভ টেলি ইন্টারভিউতে সমস্ত প্রশ্নের জবাব মিলবে।
পাকিস্থানি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, তিনি প্রায় এক দশক ধরে পাকিস্থানে রয়েছেন। তাকে একজন ব্লগার, ফিল্মমেকার ও সোশ্যাল মিডিয়া উৎসাহী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
তার ফেসবুক পেজে লেখা রয়েছে তিনি লুইজিয়ানার বাসিন্দা, লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তার মাস্টার্স ডিগ্রি ও হাউস্টন স্কুল অফ ল, পেপারডাইন ইউনিভার্সিটি ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস কমিউনিকেশন, ক্রিমিনাল জাস্টিস, কনফ্লিক্ট রেজলিউশন, ক্লিনিকাল অ্যান্ড বিহেভিয়ারাল সাইকোলজি ও স্ট্র্যাটেজিক পাবলিক রিলেশনে স্নাতক স্তরের ট্রেনিং রয়েছে। তার বায়োডেটায় বলা হয়েছে তিনি ফিল্মমেকিং সংস্থা ডিফারেন্ট লেনস প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত। এই সংস্থা ফেসবুক পেজে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সোয়াট উপত্যকার ছোট ভিডিও রয়েছে।
ইন্টারনেট সার্চ করে সিন্থিয়ার ব্লগের হদিশ মেলেনি। যদিও তিনি গত ১০ বছর ধরে বলে আসছেন যে তিনি তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, সেটা সম্ভবত তিনি এখনও বানিয়ে উঠতে পারেননি।
পাকিস্থানি ম্যাগাজিন থেক্সপাটে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিন্থিয়া বলেছিলেন, ২০১০ সালে সে দেশে বন্যার সময় থেকে তিনি পাকিস্থানে আছেন। তার যাতায়াতের খরচ জোগান পাকিস্থানি আমেরিকানরা।
ওই পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তাকে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি শ্রোতাদের পাকিস্থানের ইমেজ সম্পর্কে চমকে দিতে ভালবাসেন। তিনি বলেন, আমেরিকান সংবাদমাধ্যম পাকিস্থান সম্পর্কে অতি নে’তিবাচক।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে তিনি বলেন, পাকিস্থানিরা আমাকে বলেছেন তোমার মত মানুষ আমাদের প্রয়োজন, যাতে মানুষ জানতে পারে আমরা কেমন, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের বিশ্বাস কী রকম… যখন লোকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কেন পাকিস্থানকে বেছে নিলাম, তখন আমি উত্তর দিই আমি পাকিস্থানকে বাছিনি, পাকিস্থানই আমাকে বেছে নিয়েছে।
তবে পাকিস্থানের কেউ কেউ তার সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা বলেছিলেন ভদ্রমহিলা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তি এবং তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, কীভাবে তিনি বছরের পর বছর পাকিস্থানে থাকার ভিসা পেয়ে যান, এবং সেই সব জায়গায় যাওয়ার অধিকার পেয়ে যান যেখানকার ক্লিয়ারেন্স দিয়ে থাকে পাকিস্থান শাসনকারী সামরিক প্রতিষ্ঠান।
তার ফেসবুক পেজে দেখা যাচ্ছে তিনি কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিরু’দ্ধে লবিইংয়ে সক্রিয়। কেউ কেউ মনে করেন তিনি সিআইএ এজেন্ট, যার পাকিস্থানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের গভীরে যোগাযোগ রয়েছে। অন্যরা মনে করেন, তিনি পাকি মিলিটারির হয়ে কাজ করছেন। এবং এই টুইট অ’সামরিক রাজনীতিবিদদের বিরু’দ্ধে, বিশেষ করে পিপিপি-র বিরু’দ্ধে তাদের সাম্প্রতিকতম আঘা’ত।
সাংবাদিক, ভারত-পাকি শান্তিকর্মী তথা মানবাধিকার কর্মী বীণা সারওয়ার বলেন, আমি জানি না উনি সর্বসমক্ষে যা বলছেন তেমন অভিজ্ঞতা ওর হয়েছে কি না। এ ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। তবে উনি এমন সময়ে এই অভিযোগ এনেছেন যার ফলে এখন দেশ মূল যে বিপদের সামনে রয়েছে সেই স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির সং’কট থেকে দৃষ্টি সরে গেল। পিপিপি নেতৃত্বাধীন সিন্ধ সরকার সং’ক্রমণ আটকাতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার যার চরম বিরো’ধিতা করছে।
পাকিস্থানি সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েষা সিদ্দিকি বলেন, এই ধরনের অভিযোগ রাজনৈতিক দলগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে, তাদের জনসমক্ষে সম্মানহা’নি ঘটে, সম্ভবত প্রশাসনিক অভাব অভিযোগের মত বিষয় থেকে নজর ঘোরাতে এরকম করা হয়ে থাকে।
পাকিস্থানে এখন প্রায় ১ লাখ কোভিড পজেটিভ কেস রয়েছে, মা’রা গিয়েছেন ২ হাজার জন। এমনটাও কাকতালীয় হতে পারে যে অভিযোগ এমন সময়ে এসেছে যখন সবে দশম জাতীয় অর্থ কমিশন গঠিত হয়েছে। কোভিড উত্তর পাকিস্থানে ৪টি প্রদেশের পক্ষে চরম গুরুত্বপূর্ণ হবে অর্থের বরাদ্দ।
পিপিপি ১০ বছর আগে ক্ষমতায় এসে প্রদেশগুলির মধ্যে সম্পদব ণ্টনে বদল এনেছিল যা বর্তমান সরকার বদল আনার চেষ্টা করলেও তা প্রতিরোধ করেছে একই সঙ্গে সংবিধানে প্রগতিশীল অষ্টাদশ সংশোধনী বাতিলের বর্তমান সরকারের চেষ্টাও আটকিয়েছে।
সিন্থিয়া পাকিস্থান তহাফুজ মুভমেন্ট (পিটিএম)কেও টেনে এনেছেন। এই গোষ্ঠী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট, বিশেষ করে পাকিস্থানে আফগান নীতির ভৌগোলিক কেন্দ্র দক্ষিণ ও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে।
পিপিপি-র তার বিরু’দ্ধে আনা অভিযোগের পর তদন্তকারী সংস্থাকে দেওয়া এক চিঠির উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি পিপিপি-র সঙ্গে পিটিএম-এর যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত করছেন। পিটিএম জি’হাদি গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্থানের ছায়াযু’দ্ধের ক’ট্টর সমালোচক। রাজনৈতিক দল হিসেবে ২ বছর মাত্র বয়স হলেও এরাই একমাত্র সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি যারা পাকি সেনাবাহিনীকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
পিটিএমের সদস্য সমর্থকরা সিন্থিয়ার স্বার্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
নিজের উল্লিখিত তথাকথিত চিঠিতে সিন্থিয়া বলেছেন, তিনি সরকার ও পাকিস্থান সেনার সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু সংস্থার সঙ্গে “নিবিড়ভাবে যুক্ত” থেকে কাজ করেছেন, যেমন কাউন্টার টেররিজম বিভাগ, খাইবারপাখতুনওয়ারার মহিলা কম্যান্ডো, হাইওয়ে ও মোটরওয়ে পুলিশ, মিলিটারি, নাকটা প্রভৃতি।
সিদ্দিকার কথায় বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, ভারতে যখন ভারতের নীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাডেমিক কাজ হচ্ছে, তখন পাকিস্থানকে তাদের ভাবমূর্তির জন্য এইরকম অদ্ভুত পথের আশ্রয় নিতে হচ্ছে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ থেকে বোঝা যায় যে ক্ষমতাসীনদের পাকিস্থানিদের উপর কোনও ভরসা নেই, তার চেয়ে তারা বিদেশি সন্দেহজনক চরিত্রের উপর বেশি ভরসা করেন।
এরই মধ্যে পরিচিত টেলিভিশন সেলিব্রিটি আলি সালিম দাবি করেছেন, ইমরান খান যে সিন্থিয়াকে কু’প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে কথা সিন্থিয়া নিজেই তাকে জানিয়েছেন।
সিন্থিয়া এর জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, আলি সালিমের নে’শা করার ইতিহাস সুবিদিত এবং এখন তার স্বাস্থ্য ভাল নেই।
যু’দ্ধ চলছে মূলত টুইটারেই। সেখানে সিন্থিয়ার সমর্থকরা যে কোনও প্রশ্নকারীকে দেশদ্রো’হী ও পাকিস্থানবিরো’ধী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে এবং সিন্থিয়াবিরো’ধীরা তার ভিসা, কাজ ও কে তাকে অর্থ জোগাচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
মানবাধিকার কর্মী মারভি সিরমেদ সিন্থিয়াকে নিয়ে স্লাট শেমিং করতে নিষে’ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের বন্ধুরা কেন ওকে গাল দিচ্ছেন, অপমান করছেন, যখন আমরা সকলেই জানি য কে ওঁকে নিয়োগ করেছেন? উনি পাকিস্থানে হয়ত তাদেরই হাতে পণব’ন্দি। প্লিজ কখনও মহিলাদের স্লাট শেমিং করবেন না। কক্ষণও না।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস